
আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যতম আলোচিত ক্ষেত্র হলো সৌর বহির্ভূত গ্রহ বা এক্সোপ্ল্যানেট অনুসন্ধান। আমাদের সৌরজগতের বাইরের এই রহস্যময় জগতের অস্তিত্বের প্রকৃত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া শুরু হয় মাত্র কয়েক দশক আগে। নাসার তথ্যভাণ্ডারে সংযোজিত সর্বশেষ ফলাফল অনুসারে, বর্তমানে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত সৌর বহির্ভূত গ্রহের সংখ্যা ছয় হাজার অতিক্রম করেছে। এই মাইলফলক মানবজাতির মহাকাশ অন্বেষণ যাত্রায় এক অনন্য নজির। প্রথম নিশ্চিত এক্সোপ্ল্যানেট শনাক্ত হয় ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে। তারপর থেকে প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে গ্রহ শনাক্তকরণ পদ্ধতিতে বিপ্লব ঘটে। সবচেয়ে কার্যকর কৌশলগুলির মধ্যে অন্যতম হলো ‘ট্রানজিট মেথড’, যেখানে কোনো গ্রহ তার নক্ষত্রের সামনে দিয়ে গেলে আলোর তীব্রতা সূক্ষ্ম হ্রাস পায় এবং সেটাকেই পর্যবেক্ষণ করা হয়। পাশাপাশি ‘রেডিয়াল ভেলোসিটি পদ্ধতি’ ব্যবহার করে নক্ষত্রের অল্প দুলুনি নিরীক্ষণ করা হয়- যা কাছাকাছি গ্রহের মহাকর্ষীয় প্রভাবে ঘটে। নাসার কেপলার স্পেস টেলিস্কোপ এবং পরবর্তীতে TESS (Transiting Exoplanet Survey Satellite) এই অনুসন্ধানে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। এসব যন্ত্রের কল্যাণে হাজার হাজার সম্ভাব্য প্রার্থী শনাক্ত হয়। পরবর্তীতে অনেকেই নিশ্চিত সৌর বহির্ভূত গ্রহ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত এক্সোপ্ল্যানেটগুলির মধ্যে রয়েছে চমকপ্রদ বৈচিত্র্য। কোনোটি বৃহস্পতির চেয়েও বড়, আবার কোনোটি পৃথিবীর মতো পাথুরে ও ছোট আকৃতির। কিছু গ্রহ নিজেদের নক্ষত্রকে কয়েক ঘণ্টায় প্রদক্ষিণ করে। আবার কারো কক্ষপথ সম্পূর্ণ হতে লাগে শত শত বছর। আবিষ্কৃত এই বৈচিত্র্য মহাবিশ্বের গ্রহতাত্ত্বিক বিবর্তনের বহুমাত্রিক সম্ভাবনা সামনে আনে। গবেষকরা বিশেষভাবে আগ্রহী সেই গ্রহগুলিকে নিয়ে, যেগুলো তাদের নক্ষত্রের “বাসযোগ্য অঞ্চল”-এ অবস্থান করছে। এখানে তরল অবস্থায় জল থাকার সম্ভাবনা থাকে, যা জীবনের বিকাশের অন্যতম শর্ত বলে বিবেচিত । তবে এই এক্সোপ্ল্যানেট গবেষণা কেবল জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে না, জীবনের উৎপত্তি ও মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান সম্পর্কেও মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করে। পৃথিবী কি একমেবাদ্বিতীয়ম? নাকি মহাবিশ্ব জুড়ে জীবনের জন্য আরও অনুকূল পরিবেশ ছড়িয়ে আছে? —এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এসব অনুসন্ধান অপরিহার্য।
নতুন প্রজন্মের মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্র, যেমন জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এক্সোপ্ল্যানেটগুলির বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ করতে সক্ষম। এর মাধ্যমে মিথেন, অক্সিজেন বা জলীয় বাষ্পের মতো রাসায়নিক চিহ্ন শনাক্ত করা সম্ভব, যা জীবনের উপস্থিতির ইঙ্গিত দিতে পারে। বর্তমান ছয় হাজার নিশ্চিত এক্সোপ্ল্যানেটের সংখ্যাই বিশাল। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়েতেই শত শত কোটি গ্রহ থাকতে পারে। উন্নত প্রযুক্তি এবং আরও শক্তিশালী টেলিস্কোপের মাধ্যমে আগামী কয়েক দশকে সেগুলির আবিষ্কারের হার বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। শুধু গ্রহ শনাক্ত করাই নয়, তাদের ভৌত বৈশিষ্ট্য, বায়ুমণ্ডলীয় গঠন, এমনকি সম্ভাব্য জলবায়ু বিশ্লেষণ করাই হবে ভবিষ্যতের মূল লক্ষ্য। এর ফলে এক্সোপ্ল্যানেটগুলিতে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
সূত্র: Exoplanet count soars past 6,000 with more to come; By Eric Ralls, EarthNews; 23.09.2025