
মানুষের মস্তিষ্কে মোটের উপর ১০০ বিলিয়ন স্নায়ুকোষ বা নিউরন পরস্পরের সঙ্গে বিজড়িত হয়ে আছে। এদের মধ্যে বিদ্যুত্গতিতে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। সেটা মূলত হয় নিউরনদের সংযোগকেন্দ্রে (সাইন্যাপ্স) সংকেত সঞ্চারণের মাধ্যমে। সেখানে চলে কিছু জটিল বিদ্যুৎ-রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। এরা প্রেরক কোষ আর গ্রাহী কোষ এ দুয়ের মাঝের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ফাঁকগুলোর মধ্যে সেতু বাঁধে। এর অন্তর্লীন প্রক্রিয়াটি আমাদের জানা। প্রেরক নিউরনটির ক্যালসিয়াম আয়ন নির্দিষ্ট কিছু সেন্সর প্রোটিনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে। সেই নির্দিষ্ট প্রোটিনগুলোর তাড়নায় স্নায়ু-বার্তা-প্রেরক বার্তাবহগুলি কোষ থেকে বেরিয়ে এসে সাইন্যাপ্সে সংকেত সঞ্চারণ করে। সেই সংকেতগ্রাহী কোষের বৈদ্যুতিক সংকেত পরিমাপ করা সম্ভব। তবে মস্তিষ্কের যেসব মহল সংকেত সঞ্চারণকে প্রভাবিত করতে পারে তাদের মধ্যে ভালোরকম তফাত আছে। যথা নিউরনগুলির আকার, সাইন্যাপ্সের সংখ্যা, কোষের মধ্যে ক্যালসিয়ামের সঙ্গে গাঁটছড়া–বাঁধা সেন্সর প্রোটিনদের ধর্ম। এটা জানা আছে যে মস্তিষ্কবল্কলের মধ্যে যে-সঞ্চারণ ঘটে তা মস্তিষ্কের অন্যান্য মহলের সঞ্চারণের থেকে ঢের বেশি নির্ভরযোগ্য। এই মস্তিষ্কবল্কলই ধূসর পদার্থ নামে পরিচিত। এরই মধ্যে থাকে বিবিধ কাজকর্মের প্রক্রিয়াসাধনের কেন্দ্রগুলি, যথা সোম্যাটো-সেন্সরি কর্টেক্স। এইখানেই শরীর থেকে আসা ইন্দ্রিয়-লব্ধ ছাপগুলির প্রক্রিয়াকরণের প্রাথমিক ধাপগুলি সম্পন্ন হয়। তারপর সেইসব ছাপকে চালান করে দেওয়া হয় কর্টেক্সের অন্যান্য অংশে। গবেষকরা দেখেছেন, সোম্যাটো-সেন্সরি কর্টেক্স-এর সিন্যাপ্টোটাগামিন-১ নামক সেন্সর-প্রোটিনটি আগে থেকেই সাইন্যাপ্সের নিম্ন ক্যালসিয়াম-মাত্রায় সাড়া দিয়ে সংকেত সঞ্চারণের প্রক্রিয়াটি চালু করে রাখে। কিন্তু মস্তিষ্কের পিছন মহলের কোষে অবস্থিত সিন্যাপ্টোটাগামিন-২ নামক অন্য একটি সেন্সর-প্রোটিনের চরিত্র আলাদা। পঁচিশ বছর ধরে এটি নিয়ে গবেষণা চলছে। কর্টেক্সের সাইন্যাপ্সগুলি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সেগুলি শুধু যে বেশি নির্ভরযোগ্য তা-ই নয়, বেশি নমনীয়ও বটে। জীবনযাপনের মধ্য থেকে উঠে-আসা নিত্য নতুন চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে চলার কাজে মস্তিষ্কের পটুতার মূলে এই নমনীয়তা একটা মৌলিক পূর্বশর্ত। মনে হয় সোম্যাটো-সেন্সরি কর্টেক্স-এর সিন্যাপ্টোটাগামিন-১ সেন্সর প্রোটিনের ধর্মগুলিই এর কারণ।
সুস্থ মস্তিষ্কের ভিতরকার এই কারণগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারলে মস্তিষ্ক-বৈকল্য ঘটলে যেসব প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় সেগুলোকে চিহ্নিত করার একটা পথ তৈরি করা যায়, সম্ভাব্য চিকিৎসা নিয়েও কাজ করা যায়। শুধু তাই নয়, কম্পিউটার শিল্পের স্নায়ু-সংযোগজালের আরও উন্নতি ঘটানোর পথও খুলে যেতে পারে।
ইঁদুরদের মস্তিষ্ক থেকে কোষকলা সংগ্রহ করে প্রাথমিক সোম্যাটো-সেন্সরি কর্টেক্সের কোষগুলি নিয়ে পরপর কতকগুলি পরীক্ষা চালিয়েছেন বিজ্ঞানীরা, তাতে একাধিক পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন। একটা হল ‘প্যাচ-ক্ল্যাম্প’ প্রকৌশল। এর সাহায্যে এক এক জোড়া সংযুক্ত স্নায়ুর বৈদ্যুতিক সংকেত মাপা যায়। পাশাপাশি অতিবেগুনি লেজার এবং দুই-ফোটন লেজার অণুবীক্ষণ কাজে লাগিয়ে সাইন্যাপ্সের ক্যালসিয়াম মাত্রার উপর নজর রাখা ও পরিমাপ করা হয়েছে। এছাড়া তাঁরা “অ্যাক্সন পদভ্রমণ” নামে নিজস্ব এক নতুন পদ্ধতিও গড়ে তুলেছেন। অ্যাক্সন হল স্নায়ুকোষের প্রসারিত অংশ বরাবর যে-চার-পাঁচটি সাইন্যাপ্স বর্তমানে সক্রিয় তাদের নাম। এই নতুন পদ্ধতিতে তাঁরা অ্যাক্সনগুলির অবস্থান চিহ্ণিত করতে পেরেছেন। এই সাইন্যাপ্সগুলি আকারে খুব ছোটো: ১ মিলিমিটারের হাজার ভাগের এক ভাগ। এইসব উপাত্তর (ডেটা) ভিত্তিতে গবেষকরা গবেষণাধীন ওই সেন্সর প্রোটিনটির এক বিস্তারিত গাণিতিক মডেল তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন। অন্যান্য গবেষক-গোষ্ঠীও এটি ব্যবহার করতে পারবেন। প্রফেসর হার্টমুট শ্মিট-এর পরিচালনায় লাইপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ল লুডভিগ ইনস্টিটিউটের গবেষকরা এই কাজটি করেছেন।
সূত্রঃ Grit Bornschein et al, The intracellular Ca2+ sensitivity of transmitter release in glutamatergic neocortical boutons, Science (2025). DOI: 10.1126/science.adp0870