বিশ্ব উষ্ণায়ণে বদলাচ্ছে জলবায়ু। বন্যা, ভূমিকম্প, অকাল বর্ষণ, দাবানলের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা বেড়ে চলেছে ক্রমাগত। এসব বিপর্যয় থেকে রক্ষার বা বিপরীতে বিপির্যয়কেই সভ্যতায় কাজে লাগানোর কৌশল আবিষ্কার হলে তা হাতে চাঁদ পাওয়ার মতোই স্বর্ণলাভ। যেমন চীনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার অ্যাণ্ড ল্যাণ্ডস্কেপ কলেজের ডিন ও সেদেশের খ্যাতনামা নগর পরিকল্পনাবিদ ইউ কংজিয়ান শহরের বন্যা সমস্যা দূর করতে ‘স্পঞ্জ সিটি’র পরিকল্পনা দিয়েছেন। এই পরিকল্পনাকে হাতিয়ার করেই চীনের বহু শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে। কংজিয়ান মনে করেন বিশ্বের অন্যান্য শহরেও ‘স্পঞ্জ সিটি’ গড়ে তোলা সম্ভব। অবশ্য প্রবল বন্যায় পরিকিল্পনা কার্যকর হবে কিনা সে নিয়ে সংশয় আছে।
কী এই স্পঞ্জ সিটি
বন্যায় পরিত্রান না খুঁজে বন্যাকেই কীভাবে ব্যবহার করা যায়- এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই চমকপ্রদ নগর পরিকল্পনা করে ফেলেন কংজিয়ান। বন্যা নিয়ন্ত্রণে আধুনিক কালে যে মূল পরিকল্পনার ওপর জোর দেওয়া হয় সেগুলির অন্যতম হলো নদীর দুপাড় কংক্রিট দিয়ে বাঁধাই করা। তাতে যতক্ষন বন্যার জল না উপচাচ্ছে ততক্ষন রক্ষা। এছাড়াও ড্রেনেজ সিস্টেম উন্নত করে বন্যার জল দ্রুত বের করে বন্যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। তবে কংজিয়ানের পরিকল্পনা এসব থেকে আলাদা। বস্তুত তিনি । ঘরের মেঝেতে জল পড়লে যেমন শুকনো কাপড় বা স্পঞ্জ দিয়ে সে জল শুষে কোনো পাত্রে তোলা হয় ফেলার জন্যে, অনেকটা তেমনি ভাবনা কাজ করেছে কংজিয়ানের পরিকল্পনায়।
স্পঞ্জ সিটি বন্যার জল শুষে নিয়ে বন্যার গতিকে স্লথ করে। তিনটে ভাগে গোটা কাজটা হয়। প্রথমভাগে, বন্যার জল ঢোকার স্থানে স্পঞ্জের গর্তের মতো শহরে জলাশয় তৈরি করে জল ধরে রাখা হয়।
দ্বিতীয়ভাগে, গাছপালা লতাগুল্ম দিয়ে জলের গতি কমিয়ে আনা হয়, এবং জলের গতিকে সোজা প্রবাহিত হতে না দিয়ে বক্ররেখায় প্রবাহিত করার ব্যবস্থা করা হয়। এই দ্বিতীয় কাজের একটি বাড়তি সুবিধেও আছে। শহরের মধ্যে অনেক খোলা স্থান তৈরি করতে হয়, তৈরি হয় ফরেস্ট পার্ক- তা হয়ে উঠতে পারে বসবাসের জায়গা। জলজ লতাগুল্ম বন্যার জলের দূষণ কাটাতেও সাহায্য করে।
তৃতীয়ভাগের কাজটি হলো জল বেরোনোর জায়গা ক্লিয়ার রাখা। সেজন্যে নিচু জায়গায় বসতি গড়া যাবে না। আর এমনিও বন্যার জল কে আটকে রাখা যাবে না। তার যাওয়ার পথ ছাড়তেই হবে।
এতে যে শুধু বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তা নয়, বন্যার জল সংরক্ষণ করা যাবে, কৃষি ব্যবস্থায় যা ব্যবহার করা সম্ভব। সেইসাথে বন্যায় ব্যপক অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকেও রক্ষা করা যাবে স্থানীয় এবং দেশের অর্থনীতিকে।
কীভাবে এ পরিকল্পনা মাথায় এলো কাংজিয়ানের?
চীনের ঝেজিয়াং প্রদেশের উপকূলীয় এলাকায় কৃষি কমিউনে বেড়ে উঠেছিলেন ইউ কাংজিয়ান। সেখানে চীনা কৃষির ঐতিহ্য অনুসারে বৃষতির জল পুকুর ডোবাতে ধরে রাখা হতো। ঐ অঞ্চলের নদীর বন্যাতেই ঢুবতে বসেছিলেন ১০ বছর বয়সে। নদীর পাশের লতাগুল্ম ধরে প্রাণরক্ষা পেয়েছিলেন সেবার। সেসময়ই তার মাথায় স্পঞ্জ সিটির ভাবনা এসেছিলো প্রথম। ১৭ বছর বয়সে তিনি চলে যান বেইজিং – শেখেন ল্যান্ডস্কেপিং এর কাজ। ১৯৯৭ এ চীনে ফিরে দেখেন দেশ জুড়ে চলছে নির্মাণের মহাযজ্ঞ। ইট পাথরের প্রাণহীন জঙ্গল দেখে স্তম্ভিত হয়ে বলতে শুরু করেন স্পঞ্জ সিটির পরিকল্পনার কথা৷
অধ্যাপক ইউ মনে করেন, ”পশ্চিমের নগর পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি ডিজাইন এশিয়ার বর্ষা মৌসুমের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না। প্রাচ্যের দেশে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি থেকে ধার করা নগর পরিকল্পনায় তৈরি শহর টিকতে পারে না।” ২০১৫ তে প্রেসিডেন্ট শি জিং পিং এর সমর্থনের পর সরকারী ভাবে ২০৩০ এর মধ্যে চীনের শহুরে এলাকার ৮০% স্পঞ্জ সিটি হিসেবে গড়ে তোলার ও বৃষ্টির জলের ৭০% পুনর্ব্যবহারের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে।
ইউনিভার্সিটি অফ নটিংহ্যাম নাংগবোর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ ফেইথ চেন বলেন, যেসব জায়গায় হালকা বন্যা বা বৃষ্টিপাত হয় সেখানে স্পঞ্জ সিটির ধারণা বেশি কার্যকর হবে”।
কাংজিয়ানের ল্যান্ডস্কেপিং কোম্পানি ‘টুরেনস্কেপ’ স্পঞ্জ সিটির পরিকল্পনা তৈরির জন্যে পেয়েছে বহু পুরস্কার। কাংজিয়ান মনে করেন, কংক্রিট ব্যবহার করে বন্যা সামাল দেওয়া অনেকটা তৃষ্ণা মেটাতে বিষ পান করার মতো।