স্বল্পবুদ্ধির মানুষকে ‘পায়রার সাইজের মাথা’ ব’লে ব্যঙ্গ করার দিন বোধহয় শেষ।
আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন গবেষণা জানাচ্ছে চমকপ্রদ তথ্য – পায়রাও নাকি পৃথক করতে পারে স্পেসটাইমের অবিচ্ছেদ্য নিপুণ জাল। তবে এই কাজে মানুষ এবং বানরপ্রজাতির প্রাণীরা মস্তিষ্কের যে অংশটি ব্যবহার করে, পায়রার ক্ষেত্রে সেটি আলাদা। পায়রাদের কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে বসিয়ে মজাদার এক পরীক্ষা বিজ্ঞানীরা করেছেন। পর্দায় অনুভূমিক স্থির কিছু সরলরেখা ফুটে ওঠে । কতটা লম্বা ঐ লাইনগুলি বা কতক্ষণ লাইনগুলি স্থায়ী হয় স্ক্রিনে – বিচক্ষণের মতোই, পায়রারা দীর্ঘ লাইনগুলিই চিহ্নিত করে যেগুলি তাদের সামনে বেশিক্ষণ দেখানো হয়েছে । অথবা দীর্ঘস্থায়ী যে লাইনগুলির দিকে তারা ইঙ্গিত করে, সেই লাইনগুলি প্রকৃতই লম্বায় বড়ো ।
“অর্থাৎ পায়রার মস্তিষ্কের একটি সাধারণ অঞ্চলই নিয়ন্ত্রণ করে তার স্পেসটাইম পৃথক করার ক্ষমতা”, বলছেন আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এডওয়ার্ড ওয়াসেরম্যান । মানুষ ও তার পূর্বসূরিদের মতোই পায়রাও স্পেসটাইমকে অভিন্নরূপেই বিচার করে ।
আরও একবার বোধহয় প্রমাণ হল, পাখি সরীসৃপ বা মাছের মতো নিম্নবর্গীয় প্রাণীরাও উচ্চমানের অদ্ভুত কিছু সিদ্ধান্ত নির্ণয়ে সক্ষম। পায়রা, কাক, বেবুন ও অন্যান্য প্রাণীদের বিচারশক্তি নিয়ে প্রফেসর ওয়াসেরম্যান প্রায় চার দশক যাবৎ কাজ করছেন । তাঁর মতে, খেচরগোষ্ঠীর স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষমতা মোটেই ব্যাঙ্গের বিষয় নয়, বরং মানুষ ও বানরপ্রজাতির তুলনায় এই ব্যাপারে খুব বেশী পিছিয়ে নেই পাখিরা ।
মানুষের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের পেরিটাল কর্টেক্স অংশটি স্পেসটাইম সম্বন্ধীয় নির্ণয়ে সাহায্য করে। পেরিটাল কর্টেক্স পায়রার মগজে নেই, অথবা থাকলেও তা অনুন্নত । সুতরাং, পায়রা নিশ্চিতভাবেই মস্তিষ্কের অন্য কোনো অংশের সহায়তায় স্পেসটাইম বিচার করে । অন্যভাবে বললে, বিবর্তনই হয়তো স্পেসটাইম নির্ধারণ করার ঐশ্বরিক মন্ত্র লুকিয়ে রেখে দিয়েছিল বানর ও পাখিদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে। রহস্যটা তাহলে কী ? – ওয়াসারম্যান এবং তাঁর টিম খুঁজতে নেমেছিল নেপথ্যটি ।
পায়রাদের নিয়ে এই বিচিত্র পরীক্ষাটির পোশাকি নাম ‘কমন ম্যাগনিচিউড টেস্ট’ । কম্পিউটার স্ক্রিনে ৬ বা ২৪ সেমি-র অনুভূমিক সরলরেখা ফুটে উঠবে ২ বা ৮ সেকেন্ডের জন্য । এই চারটি চিহ্নের মধ্যে একটিতে ঠোঁট ঠেকাবে পাখিরা – সঠিক হ’লে তাদের দেওয়া হবে খাবার । ফলত, সূক্ষ্মতর হয়ে উঠলো পরীক্ষাটি । বিভিন্নতার জন্য অন্যান্য দৈর্ঘ্যের লাইন নতুনভাবে আনা হল স্ক্রিনে । আগের মতোই স্থায়িত্বের তারতম্যও রইলো । বিজ্ঞানীরা দেখলেন, লাইনের স্থায়িত্ব মাপতে গিয়ে পায়রারা প্রভাবিত হল লাইনের দৈর্ঘ্যের দ্বারা, এবং উল্টোটা। স্পেসটাইমের এই যুগ্ম লীলা অনুরূপভাবেই মানুষ ও বানরজাতীয় প্রাণীদের ক্ষেত্রেও একটি কমন নিউরাল কোডিং-এর মাধ্যমেই হয়ে থাকে। আগে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল মস্তিষ্কের পেরিটাল কর্টেক্স অঞ্চলেই নিয়ন্ত্রিত হয় স্পেসটাইমের সিদ্ধান্ত । যেহেতু পায়রাদের এই পেরিটাল কর্টেক্স নেই, তাই ওয়াসারম্যানের গবেষণা অনুযায়ী, সবক্ষেত্রে হয়তো পেরিটাল কর্টেক্সের ভূমিকা থাকে না।
‘নন-কর্টিকাল ম্যাগনিচিউড কোডিং অফ স্পেস অ্যান্ড টাইম বাই পিজিয়নস’ শীর্ষক প্রবন্ধটি ৪ঠা ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছে ‘কারেন্ট বায়োলজি’ জার্নালে ।
আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের স্নাতক বেঞ্জামিন দে কার্তে পুরো গবেষণাটির কারিগরি নকশা তৈরি করেছেন । তাঁর মতে, পায়রাদের স্পেসটাইম বোঝার পিছনে রয়েছে তাদের মস্তিষ্কেরই অন্য ধরণের গঠন। আরেকজন স্নাতকের ছাত্র ভিক্টর নাভারো পরীক্ষাটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় সাহায্য করেছেন ।