
মানুষের মস্তিষ্কে আত্মজীবনীমূলক স্মৃতিশক্তি এমন এক ক্ষমতা যা শৈশব থেকে শুরু করে জীবনভর ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতাকে সংরক্ষণ করে। এতে শুধু তথ্য নয়, আবেগ, গন্ধ, শব্দ কিংবা দৃশ্যের মতো ইন্দ্রিয়লব্ধ উপাদানও জড়িত থাকে। তবে সময়ের সাথে সাথে বেশিরভাগ মানুষের স্মৃতি ঝাপসা হয়ে আসে। কিছু পুরোপুরি হারিয়ে যায়। আবার কিছু আংশিকভাবে পুনর্গঠিত হয়। কিন্তু পৃথিবীতে বিরল কিছু মানুষ আছেন, যাদের স্মৃতিশক্তি এতটাই অসাধারণ যে তারা নির্দিষ্ট দিন-তারিখের সঙ্গে জীবনের ঘটনা মেলাতে পারেন। এদের বলা হয় ‘হাইপারথিমেসিক’। প্যারিস সিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ভ্যালেন্তিনা লা কোর্তে জানান, “এই মানুষরা যেমন ২০০২ সালের ৬ জুলাই কী করেছিলেন তা বিস্তারিতভাবে মনে করতে পারেন, তেমনই সেই দিনের আবেগ ও অনুভূতিও আবার অনুভব করতে পারেন।” অধিকাংশ গবেষণায় হাইপারথিমেসিয়াকে একধরনের ‘বোঝা’ হিসেবে দেখা হয়। কারণ, স্মৃতির স্রোতে দুঃখজনক কিংবা অপ্রয়োজনীয় তথ্যও ভেসে আসে। কিন্তু প্যারিস ব্রেন ইনস্টিটিউটের, লরাঁ কোহেন ও লা কোর্তের সাম্প্রতিক গবেষণায় পাওয়া যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। তাদের গবেষণার কেন্দ্রে ছিল ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরী। বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, সে নিজের স্মৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। দুই ধরনের স্মৃতির কথা এক্ষেত্রে উঠে আসে। ক.“কালো স্মৃতিঘর”- স্কুলে শেখা তথ্য, যা আবেগশূন্য তথ্য মাত্র। খ. “সাদা স্মৃতিঘর”- ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। এখানে স্মৃতিগুলো বিষয় ও সময় অনুযায়ী ‘ফোল্ডার’ বা ঘরের মতন করে সাজানো থাকে। কিশোরীটি মানসিকভাবে সময় বিশেষে পারিবারিক ভ্রমণ, বন্ধুবান্ধব, কিংবা শৈশবের মুহূর্তগুলো খুঁজে বের করে। কিছু স্মৃতি তার কাছে মেসেজ বা ছবির মতো ভেসে ওঠে। তার স্মৃতিভুবনে আবেগ নিয়ন্ত্রণের বিশেষ কৌশল রয়েছে। দাদার মৃত্যুর স্মৃতিকে সে ‘সাদা ঘরের’ ভেতরে একটি সিন্দুকে বন্দি করেছে। রাগ কমানোর জন্য আছে ‘বরফঘর’। আবার সমস্যা নিয়ে চিন্তা করার জন্য আলাদা ‘সমস্যার ঘর’ আর বাবার সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর কল্পনায় গড়ে তুলেছে এক ‘সামরিক ঘর’।
গবেষকরা TEMPau ও TEEAM নামের মানসিক পরীক্ষা ব্যবহার করে কিশোরীটির স্মৃতিশক্তি মূল্যায়ন করেন। দেখা যায়, সে অতীতকে অসাধারণ তীব্র ও জীবন্ত ভাবে পুনর্জীবিত করতে পারে। কখনও নিজের ভেতর থেকে, আবার কখনো পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি থেকে। ভবিষ্যৎ কল্পনার ক্ষেত্রেও তার বর্ণনা সাধারণ মানুষের তুলনায় বহুগুণ সমৃদ্ধ। সময়, স্থান ও অনুভূতির খুঁটি নাটিতে পূর্ণ। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, হাইপারথিমেসিয়ার পেছনে হয়তো মস্তিষ্কের কিছু স্মৃতিনির্ভর নেটওয়ার্ক অতিরিক্ত সক্রিয়। তবে কাঠামোগত কোনো পার্থক্য এখনও ধরা পড়েনি। গবেষণায় এ ইঙ্গিতও মিলেছে যে হাইপারথিমেসিয়া ও সিনেস্থেসিয়ার (যেখানে এক ইন্দ্রিয় অন্য ইন্দ্রিয়কে সক্রিয় করে) মধ্যে কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে। কিশোরীটি নিজে সিনেস্থেট নয়। তবে তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য এ বৈশিষ্ট্য বহন করেন। এখনও অনেক প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত। বয়স বাড়লে কি এ ধরনের স্মৃতি পরিবর্তিত হয়? স্মৃতির স্রোত কি নিয়ন্ত্রণ করা যায়? নাকি বছরের পর বছর ধরে জমা হওয়া অভিজ্ঞতা একসময় অসহনীয় হয়ে ওঠে? লা কোর্তে বলেন, “হাইপারথিমেসিয়ার এখনও অল্প কয়েকটি কেসই জানা গেছে। তাই সাধারণীকরণ এখনই সম্ভব নয়। তবে প্রতিটি পর্যবেক্ষণ, আমাদের মানবস্মৃতির রহস্য বোঝার নতুন জানালা খুলে দিচ্ছে।”
সূত্র: “Autobiographical hypermnesia as a particular form of mental time travel” by Valentina La Corte, Pascale Piolino and Laurent Cohen, 1 August 2025, Neurocase.