হাঙরদের না-বলা বাণী

হাঙরদের না-বলা বাণী

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৩১ মার্চ, ২০২৫

এতকাল বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, হাঙর আসলেই নীরব প্রাণী। স্বরযন্ত্র বা ড্রামিং পেশীর মতো বিশেষ কাঠামো না থাকায় হয়ত এরা, তিমি বা ডলফিনের মতো শব্দ করতে পারে না। কিন্তু প্রকৃতি সর্বদাই আমাদের বিস্মিত করতে প্রস্তুত। অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লেই মারাইন ল্যাবরেটরিতে সম্প্রতি যে আবিষ্কার হয়েছে তা হাঙরের ডাক সম্পর্কে নতুন তথ্য দিয়েছে। হাঙর মোটেই মূক প্রজাতি নয়। রয়্যাল সোসাইটি ওপেন সায়েন্স-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় হাঙরের শব্দ উৎপাদন প্রথম রেকর্ড করা হয়েছে। রিগ হাঙর মাস্টালুস লেন্টিকুলাটুস নামক একটি প্রজাতি, নিউজিল্যান্ডের স্থানীয় বাসিন্দা। আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট। পরীক্ষার সময়, দশটি কিশোর রিগ হাঙর জলের নীচে ক্লিক ক্লিক শব্দ উৎপন্ন করে। ক্লিক আওয়াজ একটি হঠাৎ করে আসা, সংক্ষিপ্ত এবং তীক্ষ্ণ শব্দ। এক্ষেত্রে এগুলি এলোমেলো শব্দ ছিল না। এগুলি ছিল ধারাবাহিক, তীক্ষ্ণ ক্লিক — উদ্দেশ্যমূলক এবং শ্রবণযোগ্য। গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক ক্যারোলিন নিডার বলেছেন, “হাঙরগুলির সংবেদনশীল স্নায়ুতন্ত্র শ্রবণের চেয়ে উন্নত।” হাঙরগুলি যখন স্বাধীনভাবে সাঁতরাচ্ছিল, তখন ক্লিকের শব্দ শোনা যায়নি। খাবার গ্রহণ বা বিশ্রামের সময়ও এটি ঘটেনি। ক্লিকগুলো তখনই শোনা যায়, যখন হাঙরগুলিকে ধরা হয়। বেশিরভাগ ক্লিক, তাদের ধরার প্রথম দশ সেকেন্ডের মাথায় শোনা যায় এবং পরে কমে আসে। শব্দগুলি সম্ভবত চাপের প্রতিক্রিয়া। হাঙররা হয়তো নিজেদের রক্ষা করতে বা শিকারীদের বিভ্রান্ত করতে এই শব্দ ব্যবহার করে। কিছু ক্লিক শব্দ শারীরিক আন্দোলনের সাথে মিলে যায়, যেমন শরীর হেলানো বা হঠাৎ বাঁক নেওয়া। গবেষকরা ২০ সেকেন্ডের মধ্যে প্রতিটি হাঙরের গড়ে নয়টি ক্লিক শব্দ গণনা করেছেন। ক্লিকগুলোর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ছিল সংক্ষিপ্ত, একক স্পন্দনযুক্ত। বাকি ক্লিকগুলো ছিল দ্বৈত স্পন্দনের, যা দ্রুত পরপর তৈরি হতে থাকে। নিডার মন্তব্য করেন, “হয়তো এই সময় তারা আর নিজেদের জীবনের জন্য ভীত ছিল না।” এই আচরণটি হয়তো পালানোর কৌশলের মতো, যা দ্রুত মনোযোগ আকর্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু হাঙরগুলি শব্দ উৎপাদনের অঙ্গ ছাড়াই কিভাবে এই শব্দগুলি তৈরি করে ? গবেষকরা মাইক্রোসিটি স্ক্যান এবং অঙ্গচ্ছেদের মাধ্যমে রিগ হাঙরের মস্তিষ্কের গঠন অধ্যয়ন করেছেন। তাদের দাঁতগুলি ‘সম্ভাব্য শব্দ উৎপাদনের যন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। রিগ হাঙরের দাঁতগুলি সমতল প্লেটের মতো সাজানো। এই দাঁতগুলি দ্রুত এবং প্রবলভাবে চলাচলের সময় একত্রে চেপে যায়। এই চাপের ফলেই সম্ভবত ক্লিক শব্দ তৈরি হয়। রেকর্ড করা শব্দগুলির গড় সময়কাল ছিল ৪৮ মিলিসেকেন্ড, এবং কম্পাঙ্ক ছিল ২.৪ থেকে ১৮.৫ কিলোহার্জের মধ্যে। বেশিরভাগ ক্লিক ৯.৬ কিলোহার্জের আশেপাশে ছিল, যা রিগের শ্রবণসীমার অনেক উপরে। তবে, প্রতিটি ক্লিকের প্রথম দমকে নিম্ন কম্পাঙ্ক ছিল যা হয়তো হাঙরদের শ্রবণযোগ্য। এই ক্লিকের উদ্দেশ্য এখনও অবধি স্পষ্ট নয়। এগুলি কি জৈবিক সংকেত? নাকি পেশী সংকোচনের একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ? তবে একটি কথা পরিস্কার যে রিগগুলির এই ক্লিক শব্দ ব্যাঘাতের সাথে সম্পর্কযুক্ত। কড এবং পিরানহা প্রমুখ টেলিওড মাছও বিপদের সম্মুখীন হলে ক্লিক শব্দ উৎপন্ন করে। সেই শব্দগুলির কোনো স্পষ্ট যোগাযোগমূলক ভূমিকা নেই। তাই এই আবিষ্কারটি, সাম্প্রতিক কিছু আবিষ্কারের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। ২০২২ সালে জানা গিয়েছিল, ডুবুরি যখন কাছাকাছি আসে, তখন স্টিংরেট এবং স্কেটেরা ক্লিকের মতো শব্দ করে। সব হাঙরই যে একইরকম আচরণ দেখাবে, তা নয়। গবেষণায় তিনটি ডাস্কি স্মুথহাউন্ড পরীক্ষা করা হয়, যা রিগের নিকটাত্মীয়। যখন এই হাঙরগুলিকে একইভাবে ধরা হয়, তখন তারা কিন্ত কোনো শব্দ করেনি। এটি প্রজাতি ভিত্তিক আচরণ বা মানুষের উপস্থিতির প্রতি ভিন্ন সংবেদনশীলতার প্রকাশ হতে পারে। এই গবেষণার ফলে হাঙরদের শব্দ উৎপাদন সংক্রান্ত ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে। এ কেবল একটি শব্দ নয়, বরং একটি অর্থবহ সংকেত। প্রথম শব্দ উৎপাদক হাঙরের তকমা পেয়েছে রিগ হাঙর। হয়ত মহাসাগরের নীরব কোণে, হাঙরদের কিছু বলার থাকতেই পারে !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seventeen − fifteen =