
পর্ব – ৩
হিমালয় পৃথিবীর সবচেয়ে নবীন ও সক্রিয় পর্বতশ্রেণি । এটি কেবল উত্তর-দক্ষিণমুখী ভাঁজ-ও-থ্রাস্ট দিয়েই গঠিত নয়। পূর্ব-পশ্চিমমুখী শিলাস্তরগুলিকে কেটে দেওয়া অসংখ্য অনুপ্রস্থ চ্যুতি, ভঙ্গরেখা, ভাঁজ ও শিলার ফাটল এর ভেতর লুকিয়ে আছে। এগুলো যেন হিমালয়ের অদৃশ্য শিরা-উপশিরা। ভূমিকম্পের ধরণ এবং নদীর উৎপত্তি ও প্রবাহকে গভীরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এর ধরণ।
ভালদিয়া প্রথম এসব তির্যক চ্যুতি ও শিলার ফাটলকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেন। যখন কোনো শিলাস্তরের আড়াআড়ি এবং উল্লম্ব উভয়দিকেই স্থানচ্যুতি ঘটে তাকে বলে তির্যক চ্যুতি। অবহিমালয়/ শিবালিক পর্বতশ্রেণিতে পাওয়া চ্যুতিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—পাওন্টা ফল্ট (বর্তমানে যমুনা টিয়ার ফল্ট নামে পরিচিত), হরিদ্বার ফল্ট, টানাকপুর ফল্ট এবং কাঠগোদাম ফল্ট। এগুলোই হিমালয় থেকে যমুনা, গঙ্গা, গৌলা ও শারদা নদীর প্রবাহপথ তৈরি করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এদের ডেক্সট্রাল (ডানমুখী) গতি লক্ষ্য করা যায়, যদিও পাওন্টা ফল্ট এর ব্যতিক্রম। শিবালিকের উভয় পাশে ভিন্ন শিলাস্তর দেখা যায়। যেমন হরিদ্বার ফল্টের পূর্বে নিম্ন ও মধ্য শিবালিক গঠনকারী, পশ্চিমে ঊর্ধ্ব শিবালিক গঠনকারী শিলা ; আবার পাওন্টা ফল্টের পূর্বে মধ্য শিবালিক, পশ্চিমে ঊর্ধ্ব শিবালিক গঠনকারী শিলা।
ভালদিয়ার সবচেয়ে বড় অবদান হলো হিমালয়ের এসব রেখাচিত্রকে ভারতের উপদ্বীপীয় ভূগর্ভস্থ গঠনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা —যেমন দিল্লি-হরিদ্বার রিজ, ফৈজাবাদ রিজ ও মুঙ্গের-সাহারসা রিজ। তাঁর মতে, উপদ্বীপের এইসব প্রাচীন শিলাস্তররেখা হিমালয় পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানকার গাঠনিক কাঠামো ভূকম্পীয় কার্যকলাপকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। এভাবেই তিনি হিমালয় ও গঙ্গা সমভূমির গঠনের “বংশগত সম্পর্ক ” প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন।
তাঁর এই গবেষণা থেকে নতুন কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে—
১. এই তির্যক চ্যুতি কি প্রধান থ্রাস্ট (এম বি টি, এইচ এফ টি)-কে সরিয়ে দেয়?
২. এরা কি আজও গঠনগতভাবে সক্রিয়? পরবর্তী কোয়াটার্নারি থেকে হোলোসিন যুগ পর্যন্ত এর গতিশীলতার প্রমাণ কী?
৩.অবহিমালয়ের ভাঁজ, নদীর দিক পরিবর্তন ও নদীর পুনর্গঠনে এই চ্যুতিগুলির ভূমিকা কতটা?
৪.ভূ-কম্পনের বিস্তারে এদের প্রভাব কী?
তাঁর পরবর্তী গবেষণা প্রমাণ করেছে, উত্তর-দক্ষিণমুখী ঢাল/ বাঁকের কারণে এমবিটি আঁকাবাঁকা হয়ে গেছে। এই ভিন্ন ভিন্ন বাঁকই শিবালিকের প্রস্থে ভিন্নতা আনে ।
এর ফলে কোথাও শিবালিক প্রশস্ত হয়ে রিসেস (পশ্চাদভূমি) তৈরি করেছে (যেমন দেহরা, পিঞ্জোর, চিতওয়ান দুন, গোরুবাথান), আবার কোথাও সরু হয়ে সেলিয়েন্ট (উচ্চভূমি) তৈরি করেছে (যেমন নাহান, কোঠদ্বারা)। সেলিয়েন্ট-রিসেস সংযোগস্থলগুলোতে প্রায়ই তির্যক চ্যুতি সক্রিয় থাকে, যা নদীর পথ পাল্টে দেয়, ঢালু ধাপ সরিয়ে দেয় এবং ভূকম্পীয় কার্যকলাপ সৃষ্টি করে।
ভালদিয়া শুধু পুরোনো গঠনই দেখাননি, তিনি হিমালয়ের আজকের জীবন্ত চেহারার দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ২০০১ সালে তিনি প্রমাণ দেন যে কুমায়ুন অঞ্চলের সব প্রধান থ্রাস্ট নতুন করে সক্রিয় হচ্ছে—এস টি ডি এফ, এম সি টি, এম বি টি ও আলমোড়া থ্রাস্ট । এর প্রমাণ লুকিয়ে আছে নদী বাঁধে এবং নদীর ঢালে হঠাৎ ভাঙনে।
যদিও কিছু গবেষক মনে করেন এসব বৈশিষ্ট্য আংশিকভাবে জলবায়ু ও ভূপতনের ফল, তবুও এইচ এফ টি ও এম বি টি-তে সাম্প্রতিক গাঠনিক গতিশীলতার বহু প্রমাণ মিলেছে। বিশেষ করে এইচ এফ টি হিমালয়ের দক্ষিণ ফ্রন্টে শিবালিক শিলাস্তরকে সমভূমির ওপর তুলে এনে সক্রিয় ভাঁজ-ও-থ্রাস্ট পর্বতশ্রেণি গঠন করছে।
ভালদিয়া লক্ষ্য করেছিলেন, এইচ এফ টি বরাবর কখনো ফাটল-সম্পর্কিত খাড়া ঢাল চোখে পড়ে, কখনো আবার আধুনিক সেডিমেন্টের নীচে চাপা পড়ে থাকে। কোথাও এটি অদৃশ্য থেকেও ভূমিরূপে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। এই ভিন্নতা ভূমিকম্পের মাত্রা, সময়কাল ও পুনরাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত। তাই তিনি জোর দিয়েছিলেন প্রাগভূকম্পন সংক্রান্ত গবেষণা ও ভূ-আকৃতিগত সমীক্ষার ওপর, যাতে ভবিষ্যতের ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলা করা যায়।
গত তিন দশকে আধুনিক ভূত্বকীয় গঠনসংক্রান্ত গবেষণা নতুন মাত্রা পেয়েছে এবং এক স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে বিকশিত হয়েছে। গবেষণার প্রধান দিকগুলো হলো—
1. সক্রিয় চ্যুতি শনাক্তকরণ ও মানচিত্রায়ন।
2. সক্রিয় চ্যুতির প্রকৃতি ও গতিবিদ্যা—এম বি টি ও এইচ এফ টি -র বিভাজন, প্রাকৃতিকভাবে গঠিত থ্রাস্টের বিকাশ, ভাঁজ-ও-থ্রাস্ট গঠন, একপার্শ্বীয় ভাঁজ স্ট্রাইক-স্লিপ গতি ও তির্যক থ্রাস্ট।
3. সক্রিয় চ্যুতির ভৌমরূপতাত্ত্বিক প্রকাশ—চ্যুতি ভৃগুতট , কোয়াটার্নারী সোপানের সরণ, নদীর পুনর্যৌবনলাভে নিকবিন্দু, নদী বাঁক, অববাহিকার পরিবর্তন, ভাঁজ ও থ্রাস্ট রূপ।
4. পরবর্তী কোয়াটার্নারী থেকে হোলোসিন যুগে ভূমির উত্তোলন ও সংকোচনের হার নির্ধারণ।
5. প্রাগভূকম্পন সংক্রান্ত ইতিহাস—ট্রেঞ্চ গবেষণার মাধ্যমে পূর্ববর্তী ভূমিকম্পের সময়, ভাঙনের দৈর্ঘ্য ও মাত্রা, সঞ্চিত চাপ ও ভাঙনের গতিবিদ্যা।
6. জলবায়ু ও ভূগাঠনিক পরিবর্তনের যৌথ প্রভাবে পরবর্তী কোয়াটার্নারী যুগের ভূদৃশ্য বিকাশ।
এই গবেষণা দেখিয়েছে, পরবর্তী কোয়াটার্নারি যুগে কেন্দ্রীয় হিমালয়ে এইচএফটি বরাবর সর্বাধিক ১৮–২০ মিমি/বছর এবং উত্তর-পশ্চিম হিমালয়ে ৮–১৫ মিমি/বছর সংকোচন ঘটেছে। এর বড় অংশ আবার, অবহিমালয়ের স্বাভাবিক স্তরক্রম ভেঙে গঠিত চ্যুতি ও এমবিটি-র পুনঃসক্রিয়তার মাধ্যমে সঞ্চালিত হয়েছে।
সব মিলিয়ে হিমালয়ের অনুপ্রস্থ গঠন ও আধুনিক ভূত্বকীয় গঠনসংক্রান্ত গবেষণা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে এই পর্বতশ্রেণি এখনো গড়ে উঠছে, বদলাচ্ছে। এর ভেতরের অদৃশ্য শক্তি প্রতিনিয়ত আমাদের ভবিষ্যৎ ভূদৃশ্যকে রূপ দিচ্ছে।
সূত্র:
01) Khadg Singh Valdiya by SK Tandon ; Resonance Journal ; Indian Academy of Science (2021).
02) Geologist Valdiya honored by The Tribune(11 May, 2015).
03) The Journey of a Foot-Soldier Geologist by Jaishri Sanwal(JNCASR) ; Journal of Science Education (March, 2021).