সম্প্রতি ভারতের বনসম্পদের অবস্থাসূচক প্রতিবেদনে (আই এস এফ আর) হিমালয় অধ্যুষিত বিভিন্ন রাজ্যে বৃক্ষআচ্ছাদন বৃদ্ধির ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। বিষয়টি শুনতে আশাব্যঞ্জক লাগলেও গবেষণাগুলো বলছে, এই ‘সবুজের সমারোহ’ আসলে এক গভীর সংকটকে ঢেকে রাখছে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে হিমাচল প্রদেশে বনের অগ্নিকাণ্ড বেড়েছে ১,৩৩৯%, আর জম্মু ও কাশ্মীরে ২,৮২২%। এই বিপুল বৃদ্ধির ফলে যেসব বনভূমি কার্বন সঞ্চয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করত, তারা আজ উল্টে কার্বন নিঃসরণকারী অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে। দাহ্য বনভূমির দ্রুত জ্বলে ওঠা কেবল যে সঞ্চিত কার্বনকে বাতাসে ফেরত পাঠাচ্ছে তাই নয়, সবুজ আচ্ছাদন বৃদ্ধির পরিসংখ্যানে যে ইতিবাচক ইঙ্গিত দেখা যায়, তাকেও কার্যত নিরর্থক করে তুলছে।
আই এস এফ আর -এর সীমাবদ্ধতা হল উপগ্রহ চিত্রে ১০% এর বেশি ছাউনিযুক্ত যেকোনো সবুজ এলাকাকে বন হিসেবে ধরা হয়। এতে প্রাকৃতিক বন আর একক প্রজাতির চাষ করা বাগিচা —দু’টিকেই একইভাবে বন বলে দেখানো হয়। ফলে পাইন, ইউক্যালিপটাস বা সেগুনের মতো অল্প কার্বনধারী ও অগ্নিপ্রবণ প্রজাতির বাগানও বন হিসাবে গণ্য হচ্ছে। অথচ আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী ণ্ড আই পি সি সি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ব্রাজিলের প্রাকৃতিক বন ও বৃক্ষরোপণকে আলাদা করে হিসাব করা হয়, যাতে কার্বন-সংরক্ষণের বাস্তব চিত্রটা দেখা যায়।
এই একরৈখিক হিসাব হিমালয়ের কার্বন ভারসাম্যকে বিভ্রান্ত করছে। কারণ, এসব রোপিত বৃক্ষ অল্প কার্বন শোষণ করে, দ্রুত শুকিয়ে যায় এবং সহজদাহ্য। আগুন লাগলে সঞ্চিত কার্বন এক ধাক্কায় বাতাসে ফিরে যায়। আরও বিপজ্জনক হলো এদের দ্রুত পুনর্জন্ম—যা ‘জ্বলা–গজানো–আবার জ্বলা’ চক্রকে স্থায়ী করে তোলে। এর ফলে বনভূমি কখনোই পরিপক্ব, উচ্চ কার্বনধারী অবস্থায় পৌঁছাতে পারে না।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দীর্ঘ শুষ্ক ঋতু, অস্বাভাবিক উষ্ণতা এবং আঞ্চলিক মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ড মোট বন্য অগ্নিকাণ্ডের ৯৫%-এর জন্য দায়ী যেমন, বিভিন্ন ফসলের ঝুম চাষ, হঠাৎ- হঠাৎ বন জ্বালিয়ে দেওয়া, এমনকি ব্যাঙের ছাতা বৃদ্ধির জন্য আগুন দেওয়া। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জনসমাজ-ভিত্তিক বন ব্যবস্থাপনার অবক্ষয়, যা বহু দশক ধরে আগুন নিয়ন্ত্রণের মূল ভরসা ছিল।
সমাধানের পথটা স্পষ্ট—সংখ্যা-নির্ভর ‘সবুজায়ন’ নয়, বরং স্থিতিশীল কার্বন সংগ্রহ ও অগ্নি-সহনশীল বাস্তুতন্ত্র পুনর্গঠন। তাই একক প্রজাতির বদলে ওক, রোডোডেনড্রনসহ স্থানীয় চওড়া পাতার মিশ্র বন পুনর্গঠনই সবচেয়ে কার্যকর পথ—যা ২–৩.৫ গুণ বেশি কার্বন ধরে রাখে এবং আগুনে ধরা থেকে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ।
আই এস এফ আর –এ শুধু ছাউনির পরিমাণ নয়, কোনো অরণ্যে আগুনের প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট পুনরাবৃত্তি ঘটার মাঝের সময়কালকে (ফায়ার রিটার্ন ইন্টারভ্যাল) যুক্ত করতে হবে, যাতে কোন বন আসলে দীর্ঘমেয়াদি কার্বন ভাণ্ডার, তা বোঝা যায়। পাশাপাশি জনসমাজ–পরিচালিত বনশাসন, আগুন–সতর্কীকরণ প্রযুক্তি, এবং আন্তর্জাতিক মানের কার্বন হিসাব ব্যবস্থা এখনই চালু করা দরকার।
হিমালয়ের বনাঞ্চল আজ এক সংকট বিন্দুর সামনে দাঁড়িয়ে। হিমালয়কে রক্ষা করা মানে শুধু বন রক্ষা নয়—এ অঞ্চলের কার্বন ভবিষ্যৎ, জলবায়ু স্থিতি এবং ভারতের প্রতিশ্রুত জলবায়ু লক্ষ্য রক্ষা করা। এখনই পদক্ষেপ না নিলে এই পর্বতশ্রেণি দ্রুতই এক অপ্রতিরোধ্য পরিবেশগত বিপর্যয়ের দিকে এগোবে।
সূত্রঃ : Forest Fires and the Eroding Carbon Balance in the Himalayas
By Dhaval Desai , Sahil Kapoor, et.al; 2nd December,2025.
