হিরোশিমার পারমাণবিক বিস্ফোরণ যাকে ধ্বংস করতে পারেনি

হিরোশিমার পারমাণবিক বিস্ফোরণ যাকে ধ্বংস করতে পারেনি

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৬ জানুয়ারী, ২০২৫

হিরোশিমায় “লিটল বয়” পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর প্রথম তিন সেকেন্ডে, বিস্ফোরণের দুই মাইল জুড়ে তাপমাত্রা বেড়ে ৭০০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে উঠে যায়। এটা কতটা তপ্ত? আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে উদ্ভূত লাভার তাপমাত্রা ২৪০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। পৃথিবীর কক্ষপথে পুনরায় যখন মহাকাশযান প্রবেশ করে, তার তাপমাত্রা ৪০০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট হতে পারে। ফলে এই মারাত্মক উত্তপ্ত বিস্ফোরণের ব্যাসার্ধের মধ্যে যারা ছিল, তারা তৎক্ষণাৎ মারা যায়, বাড়িগুলো গলে পড়ে, আর শহরের বেশিরভাগ জায়গা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। বিস্ফোরণের মূল কেন্দ্র থেকে প্রায় এক মাইল দূরে ছয়টি গিঙ্কগো বাইলোবা গাছ বেড়ে উঠছিল। পরম আশ্চর্যের বিষয়, তারা এই ভয়ানক বিস্ফোরণের ধাক্কা সামলে নেয়। পাতা ছিঁড়ে যাওয়া, বিস্ফোরণে পোড়া এই গাছগুলো কয়েক মাসের মধ্যেই সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে বেঁচে ওঠে! অবাক হবেন না, এই একটি প্রজাতি কেবল পারমাণবিক ধ্বংসই নয় বরং বরফ যুগ, ব্যাপক বিলুপ্তি এবং পরিবেশগত বিপর্যয়ের যুগ পেরিয়েও আজ বেঁচে আছে। এরা শুধুমাত্র প্রাচীন এক গাছ নয়, এরা স্থিতিস্থাপকতা, বিবর্তন, বেঁচে থাকার এক জীবন্ত দলিল।
গিঙ্কগো বাইলোবা সঙ্গত কারণে “জীবন্ত জীবাশ্ম” নামে পরিচিত। এরা ডাইনোসরের পূর্ববর্তী, এদের ২৯ কোটি বছর আগে পারমিয়ান যুগে দেখা যেত। এই গাছের পাতা পাখা-আকৃতির, এদের শক্ত কাঠামো নিয়ে গিঙ্কগো সহস্রাব্দ ধরে মোটামুটি অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। জুরাসিক যুগের জীবাশ্মে পাওয়া গিঙ্কগো গাছের পাতার সঙ্গে আধুনিক গিঙ্কগোগুলোর পাতা প্রায় অভিন্ন, যা তাদের বিবর্তনীয় স্থিতিশীলতা প্রদর্শন করে। কোটি কোটি বছর ধরে, গিঙ্কগো উত্তর সুপারমহাদেশ লরাসিয়া জুড়ে বিস্তৃত ছিল। এরপর ক্রেটাসিয়াস-প্যালিওজিন বিলুপ্তিতে ডাইনোসর, তার পাশাপাশি অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায়। অনেক প্রজাতি এই ব্যাপক বিলুপ্তির শিকার হলেও, গিঙ্কগো হারিয়ে যায়নি। তবে, পরবর্তী সহস্রাব্দে তাদের আধিপত্য হ্রাস পায় কারণ বৈচিত্র্যময় সপুষ্পক উদ্ভিদের উদ্ভব হয়, আর শুরু হয় সম্পদ ও স্থানের জন্য প্রতিযোগিতা। প্লিস্টোসিনের শেষের দিকে, বন্য গিঙ্কগোগুলো চীনে বিচ্ছিন্নভাবে ছিল। তারা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে ঠেকলেও তাদের প্রাকৃতিক স্থিতিস্থাপকতা ও মানুষের সাহায্য তাদের হারতে দেয়নি।
চীনের ঝোংনান পর্বতমালায়, গু গুয়ানিন বৌদ্ধ মন্দিরের কাছে একটি ১৪০০ বছরের গিঙ্কগো গাছ রয়েছে, প্রতি শরতে এর সোনালি পাতা মন্দিরের মাটিতে গালিচা রচনা করে। জীবদ্দশায়, এই গাছ মানব ইতিহাসের নানা সন্ধিক্ষণের সাক্ষী, সাং রাজবংশের উত্থান ও পতন, বাণিজ্য পথ – সিল্ক রুট প্রতিষ্ঠা, বিশ্বব্যাপী শিল্প বিপ্লব। বিশ শতকের গোড়ার দিকে যখন গিঙ্কগোকে বিলুপ্ত ভাবা হয়েছিল, তখন চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই গাছের আবার দেখা মেলে। মনে হয় গাছটির সৌন্দর্য, ওষধি গুণ, স্থিতিস্থাপকতার জন্য বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এদের রক্ষণাবেক্ষণ করে বাঁচিয়ে রেখেছিল। আজ বিশ্বের নানা প্রান্তের রাস্তায়, পার্কে, মন্দিরে এই গাছ শোভা বর্ধন করে। এরা শহুরে জীবনের দূষণ, পোকামাকড়, তীব্র আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিতে পারে।
তাদের দীর্ঘ জীবনের কারণ তাদের জৈবিক বৈশিষ্ট্য। এই গাছের শরীরে বার্ধক্যের থাবা বিশেষ পড়ে না। পিএনএএস-র প্রসিডিংসে বলা হয়েছে ৬০০ বছরের পুরোনো গিঙ্কগো গাছ তরুণ গাছের সমান চনমনে, রোগ ঠেকাতে সক্ষম। কোশীয় স্তরে এই গাছ, তারা সারা জীবন ধরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টিমাক্রোবিয়াল যৌগ সৃষ্টি করে, যা রোগ সংক্রমণ ঠেকাতে পারে। তাদের গুঁড়ির ক্যাম্বিয়াম নামে কোশের স্তর সবসময় সক্রিয় ও বলিষ্ঠ থেকে গাছের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এমনকি দেখা যায় পুরোনো গিঙ্কগো গাছ নতুন গিঙ্কগোর তুলনায় বেশি তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠতে পারে। তাদের কাণ্ডের পরিধি বৃদ্ধি পেয়ে পুষ্টি পরিবহনে সাহায্য করে। এছাড়াও আছে এদের অভিযোজন ক্ষমতা, তারা ক্ষতি, প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। তাদের শিকর মাটির গভীরে গিয়ে যেমন দৃঢ়ভাবে মাটিকে ধরে রাখে তেমন তা জল, পুষ্টিরও নাগাল সহজে পায়। তাদের পুরু ছাল কীটপতঙ্গ, রোগ, চরম পরিবেশ থেকে প্রাকৃতিকভাবে তাদের রক্ষা করে। গিঙ্কগোর জেনেটিক বৈশিষ্ট্য তার দীর্ঘায়ুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে প্যাথোজেন প্রতিরোধ এবং চাপের প্রতিক্রিয়ার সাথে যুক্ত জিন প্রাচীন গাছেও অত্যন্ত সক্রিয় থাকে। প্রতিরক্ষামূলক যৌগের এই অবিচ্ছিন্ন উত্পাদন কখনই দুর্বল হয় না, এই বৈশিষ্ট্যই এই গাছকে সময়ের পরীক্ষায় মানিয়ে নিতে সাহায্য করে।