পাহাড়ে চড়তে চড়তে – এক হোঁচট! সামনের পাথরের চাঙড়টার দিকে চোখ পড়তেই দেখা গেল কিছু প্রাণীর জীবাশ্ম-হয়ে-যাওয়া পায়ের ছাপ। বোঝাই যাচ্ছে, ছাপগুলো বেশ প্রাচীন। এখনকার কোনো প্রাণীর পায়ের ছাপের সঙ্গে এর কোনো মিল হতেই পারে না। এই পর্যবেক্ষণটকুর সূত্র ধরেই ইতালির পাভিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং মিলানের প্রাকৃতিক ইতিহাস সংগ্রহশালার জীবাশ্মবিদরা শুরু করে দিলেন তদন্ত।
পর্বতারোহীর নাম ক্লডিয়া স্টেফেনসেন। ২০২৩ সালে ভ্যালেন্টিনা অরোবি মাউন্টেন পার্ক হাইক করতে গিয়ে আল্পস পর্বতের প্রায় দশ হাজার ফুট উচ্চতায় ইতালীয় দিকের লম্বার্ডিতে তিনি এভাবেই আবিষ্কার করে ফেললেন ২৮ কোটি বছরের এক পুরোনো জগৎ। তখন পার্মিয়ান ভূতত্ত্বিক যুগের শেষ অধ্যায়, দ্রুত বিশ্ব উষ্ণায়নের দরুন পৃথিবীর প্রাণিকুলের প্রায় ৯০% ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। জলে-ভেজা যে সূক্ষ্ম দানাদার বেলেপাথরটি থেকে নখ, পেটের আঁশ এবং আঙুলের ছাপ সহ জীবাশ্ম পাওয়া গেল, তার নাম দেওয়া হল “রক জিরো” । চলল আরও অনুসন্ধান। একের পর এক উঠে এলো আরও অনেকগুলি প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপ, উভচর প্রাণী আর কীটপতঙ্গর পায়ের ছাপ। তার প্রতিটি খুঁটিনাটির ছবি ফুটে উঠল। যেন কেউ বিজ্ঞানীদের সুবিধার জন্য সাজিয়ে রেখে দিয়েছে! এদের মধ্যে কোনো কোনো সরীসৃপ ১০ ফুট লম্বা – আধুনিক কমোডো ড্রাগনদের প্রতিদ্বন্দ্বী বলা চলে। এছাড়া উঠে এলো উদ্ভিদের টুকরো, প্রাচীন দিঘির পাড়, প্রাচীন হ্রদ উপকূলের ঢেউ-চিহ্ন – এমনকি বৃষ্টিফোঁটার ছাপ! পুরা-প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্রিস্টিয়ানো দাল সাস্সো লক্ষ্য করলেন, তখনো বিবর্তনের পথে ডাইনোসরের আবির্ভাব হয়নি বটে, কিন্তু এইসব প্রাণীগুলি আকারে রীতিমতো বড়ো।
বোঝা গেল, একবার শুখা, একবার ভিজে পর্বর মধ্য দিয়ে যেতে যেতে কাদামাটির স্তরগুলো শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেছে। কোটি কোটি বছর ধরে আল্পস পর্বতমালা গঠনের প্রক্রিয়ায় এইসব শিলাগুলো ঠেলে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে এসেছে উপরে। এদিকে একের পর ধস নামার ফলে আর অবক্ষয়ের দরুন জীবাশ্ম-পূর্ণ শিলার চাঙড়গুলো আল্পসের উপত্যকা জুড়ে যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়েছে।
সেই যুগে আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত হতো বেশি। প্রাণীদের বাঁচতে হত চরম প্রান্তিক পরিবেশে। বিশ্ব উষ্ণায়নের দৌলতে, আমরাও তো আজ ক্রমশ চরম প্রান্তিক আবহাওয়ার দিকেই এগোচ্ছি। কীভাবে এই চরম পরিবেশের মোকাবিলা করা যায়, কীভাবে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া যায়, তা বোঝার জন্য এই আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছে।
কোনো প্রাচীন জগতের খোঁজই শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক প্রদর্শ-ভান্ডার হিসেবেই সংগ্রহশালায় জমা থাকে না। বরং আমাদের অস্তিত্বের ইতিহাস অনুসন্ধান এবং ভবিষ্যৎ পাঠের মূল্যবান সঙ্গী হিসেবেও খুবই সাহায্য করে।
(সূত্র India Today Science Desk, New Delhi, Nov 21, 2024)