
সম্প্রতি স্নায়ুবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন ঘুমের সময় মস্তিষ্ক পুরোনো শেখা বিষয়গুলো ঠিকভাবে গুছিয়ে রাখে। এতে আমরা যা শিখেছি, তা মনে রাখা সহজ হয়। একই সঙ্গে ঘুম নতুন কিছু শেখার জন্য মস্তিষ্ককে প্রস্তুতও করে। তাই ভালোভাবে শেখা ও মনে রাখার জন্য পর্যাপ্ত ঘুম খুবই দরকার।
অস্ট্রিয়ার ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (আইএসটিএ) গবেষকদের গবেষণা থেকে জানা যায় বিশ্রামের সময় মস্তিষ্ক পুরোনো তথ্যকে মনে রাখার কাজ করে। এটি আমাদের দীর্ঘদিন পর্যন্ত শিখে রাখা বিষয়গুলো মনে রাখতে সাহায্য করে।ঘুম প্রাণীদের স্মৃতি যেমন—খাবার কোথায় লুকানো আছে তা মনে রাখতে সাহায্য করে। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো পুরোপুরি বুঝতে পারেননি মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের স্তরে এটি কীভাবে ঘটে। গবেষকরা দেখেছেন ইঁদুররা ঘুমের শুরুতে ঠিক যেভাবে নতুন জায়গার তথ্য শিখেছিল, তাদের মস্তিষ্কের কোষগুলো সেই তথ্য মনে রাখে।
কিন্তু ঘুম বাড়ার সাথে সাথে মস্তিষ্কের কার্যকলাপ ধীরে ধীরে বদলে যায়। পরে, ইঁদুররা ঘুম থেকে উঠলে তাদের মস্তিষ্ক সেই তথ্য মনে করে এবং খাবারের জায়গা চিনতে সাহায্য করে।গবেষকরা আগেই দেখেছেন যে, মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস নামের অংশটি প্রাণীর চারপাশের একটি মানচিত্র তৈরি করে। এটি বিশেষ কোষ ব্যবহার করে ঠিক নির্দিষ্ট জায়গায় সক্রিয় হয়।
প্রাণীরা নতুন কিছু শিখলে এই মানচিত্র পরিবর্তিত হয় এবং আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। বিশেষ করে সেই জায়গাগুলোয়, যেখানে খাবারের সন্ধান পাওয়া যায়।আমাদের মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস হলো স্মৃতি গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ঘুমোনোর সময় এটি আমাদের শেখা তথ্যগুলোর পুনরাবৃত্তি করে, যা পুনঃ সক্রিয়করণ নামে পরিচিত। গবেষণায় দেখা গেছে, হিপোক্যাম্পাস ঘুমের সময় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য (যেমন, পুরস্কারের অবস্থান) বারবার মনে করিয়ে দিলে প্রাণী বা মানুষ এটি ভালোভাবে মনে রাখতে পারে। কিন্তু যদি এই পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা হয়, তাহলে স্মৃতি দুর্বল হয়ে যায়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে ঘুমের সময় মস্তিষ্ক পুরনো তথ্যগুলো নিয়ে চর্চা করে, ঠিক যেমন আমরা পড়া মুখস্থ করতে বারবার পড়ি।আগের গবেষণাগুলো শুধু কয়েক ঘণ্টার ঘুমের ওপর করা হয়েছিল। কিন্তু এবার বিজ্ঞানীরা পুরো রাত ধরে মস্তিষ্কের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করেছেন। তারা বুঝতে পারেন ঘুমের সময় স্মৃতি তৈরির প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে বদলায়। বিশেষ করে, পুরস্কারের অবস্থান মনে রাখার সঙ্গে জড়িত মস্তিষ্কের অংশ নতুনভাবে সাজানো হয়। গবেষক লার্স বোলম্যানের মতে দীর্ঘ ঘুমের সময় মস্তিষ্ক নিজের কার্যপ্রণালী পরিবর্তন করে স্মৃতি আরও ভালোভাবে সংরক্ষণ করে।প্রথমে ইঁদুররা ঘুমোতে যাওয়ার সময়ও শেখার জন্য সক্রিয় থাকা কিছু নির্দিষ্ট স্নায়ুকোষ ঘুমের সময়ও সক্রিয় থাকে। বিজ্ঞানীরা একে “স্থিতিশীল দল” বলেছেন।কিন্তু ঘুম যত বাড়তে থাকে কিছু পুরনো স্নায়ুকোষ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় এবং নতুন নতুন স্নায়ুকোষ তাদের জায়গা নেয়। ঘুমের শেষের দিকে, স্নায়ুকোষ গুলোর কাজ এমনভাবে বদলে যায়, যা ইঁদুরদের পরের দিন পুরস্কারের অবস্থান মনে রাখতে সাহায্য করে।গবেষকরা দেখেছেন, এই পরিবর্তন বিশেষ করে ‘এনআরইএম’ পর্বর ঘুমের সময় অর্থাৎ প্রশান্ত বা গভীর ঘুমের সময় ঘটে । আর ‘আরইএম’ পর্বর দ্রুত চোখ ঘোরানো পর্বর ঘুম এই পরিবর্তনকে থামিয়ে বা কমিয়ে দিতে পারে। আমাদের মস্তিষ্ক নতুন কিছু শিখলে, সেটা খুব দ্রুত স্মৃতিতে জমা হয়। কিন্তু এই স্মৃতিগুলো সবসময় দীর্ঘদিন ধরে রাখার জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে।
তাই ঘুমের সময় মস্তিষ্ক এই স্মৃতিগুলোকে গুছিয়ে নেয়, যাতে কম জায়গায় ভালোভাবে সংরক্ষণ করা যায়। ঠিক যেমন আমরা ফোনের মেমোরি পরিষ্কার করে দরকারি ফাইল গুছিয়ে রাখি, যাতে জায়গা কম লাগে কিন্তু প্রয়োজনীয় তথ্য ঠিক থাকে।আমাদের মস্তিষ্কে জায়গা সীমিত, তাই নতুন কিছু শিখতে গেলে পুরোনো স্মৃতিগুলোকে একটু গুছিয়ে রাখতে হয়। ঘুমের সময় মস্তিষ্ক অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দিয়ে স্মৃতিগুলোকে কম জায়গায় রাখে, যাতে নতুন অভিজ্ঞতার জন্য জায়গা খালি থাকে। গবেষকরা দেখেছেন, ঘুমের পর কোনো পুরস্কারের জায়গার স্মৃতি ধরে রাখতে কম স্নায়ুকোষ লাগে, মানে মস্তিষ্ক স্মৃতিগুলোকে আরও দক্ষভাবে সংরক্ষণ করে।
গবেষক সিক্সভারি জানান নতুন কিছু শিখলে তা আগের জ্ঞানের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হয়। বারবার মনে করা ও স্নায়ু কোষের সামান্য পরিবর্তন নতুন স্মৃতিগুলোকে আগের স্মৃতির সঙ্গে মিশে যেতে সাহায্য করে। এই গবেষণা প্রমাণ করে যে ঘুম আমাদের স্মৃতিশক্তিকে আরও শক্তিশালী করে।
ঘুমোনোর সময় মস্তিষ্ক পুরোনো স্মৃতিগুলোকে নতুনভাবে সাজায়, যাতে পরে সহজে মনে রাখা যায়। এই প্রক্রিয়াটাই ঘুমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যা আমাদের শেখার ক্ষমতাকে উন্নত করে।এই গবেষণা প্রাণীদের নিয়ে করা হলেও, এটি মানুষের স্মৃতি ও ঘুমের সমস্যার ওপর ভবিষ্যতের অন্যান্য গবেষণাকে প্রভাবিত করবে।
বিজ্ঞানীরা ঘুমের সময় স্মৃতি কীভাবে বদলায়, তা আরও ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করেছেন। এর ফলে ভবিষ্যতে শেখার ক্ষমতা বাড়ানো, মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখা এবং স্মৃতিভিত্তিক রোগের চিকিৎসার নতুন উপায় খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। গবেষণাটি নিউরোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।