
দ্বিতীয় পর্ব
হিমালয়ের অন্তঃভূত্বকীয় সীমানা – থ্রাস্টসমূহের নতুন সংজ্ঞার্থ
১. মেইন বাউন্ডারি থ্রাস্ট
প্রথমদিকে ক্ষুদ্রতর হিমালয় (হিমাচল হিমালয়) ও অব-হিমালয় (শিবালিক)-এর সীমারেখা নির্ধারণের জন্য যে কাঠামোগত সংযোগটি ব্যবহার করা হতো, তাকে বলা হতো মেইন বাউন্ডারি ফল্ট (MBF)। এ এক তীক্ষ্ণ চ্যুতি-সংযোগ, যা প্রাথমিক টার্শিয়ারি যুগের পাললিক শিলাস্তরসমূহের মধ্যে অবস্থিত — অর্থাৎ সুবাথু, দাগশাই, কাসাউলি ও শিবালিক গ্রুপের মধ্যে (পরবর্তী টার্শিয়ারি যুগ থেকে পরবর্তী কোয়াটার্নারি যুগ) ।
ভালদিয়ার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, এম বি এফ আসলে একাধিক ঠেলার বা থ্রাস্টের সমষ্টি। জম্মু থেকে নাহান পর্যন্ত কিশানপুর/রিয়াসি থ্রাস্ট, পালমপুর থ্রাস্ট, বিলাসপুর থ্রাস্ট, এবং নাহান থ্রাস্ট—যা প্রাচীন গবেষণাতেও উল্লেখিত। কিন্তু, নাহান অঞ্চলের পূর্বদিকে এম বি এফ আর প্রশস্ত নয়। এখানে লোয়ার টারশিয়ারি স্তর অনাবৃত। ফলে শিবালিক গঠনকারী শিলাগুলি সরাসরি ক্ষুদ্রতর (হিমাচল) হিমালয়ের নিম্নস্তরের রূপান্তরিত অবসাদী শিলার সংস্পর্শে রয়েছে। ভালদিয়া স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন যে, এই অঞ্চলে এম বি এফ আর ভূখণ্ড-সীমা নির্ধারণকারী ফল্ট হিসেবে নিজের স্বকীয় পরিচয় বজায় রাখতে পারেনি।
ভালদিয়ার আধুনিক সংজ্ঞার্থ অনুযায়ী, ক্ষুদ্রতর হিমালয় ও শিবালিকের ভৌগোলিক সীমারেখা মেইন বাউন্ডারি থ্রাস্ট দ্বারা নির্ধারিত। কারণস্বরূপ তিনি বলেছেন সেখানে নব্য প্রোটেরোজোয়িক ও প্যালিওজোয়িক যুগের রূপান্তরিত অবসাদী শিলাগুলি নিম্নস্থ টারশিয়ারি বা শিবালিক শিলা ঠেলে উঠে এসেছে। এম বি টি উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব হিমালয় পর্যন্ত বিভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন, জম্মু অঞ্চলে পীর পাঞ্জাল পর্বতমালার পাদদেশে। এটি স্থানীয়ভাবে “মুরি থ্রাস্ট” নামে পরিচিত, কারণ এখানে এটি ক্ষুদ্রতর হিমালয়ের শিলাগুলোকে প্রারম্ভিক টার্শিয়ারি যুগের মুরি স্তরগুলোর উপর ঠেলে নিয়ে এসেছে, যা দাগশাই ও কাসাউলি ক্রমের সমতুল্য।
কাংড়া অঞ্চলে এম বি টি ‘দ্রাং থ্রাস্ট’ নামে পরিচিত, যা ধৌলাধার পর্বতমালার পাদদেশে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত। এখানে এই থ্রাস্টের মাধ্যমে নিওপ্রোটেরোজোয়িক শিলাস্তর প্রারম্ভিক টার্শিয়ারি যুগের ধর্মশালা শিলাস্তরের (মুরি/দাগশাই ও কাসাউলি ক্রমের সমতুল্য) উপর উঠে এসেছে।
নাহান অঞ্চলে এম বি টি বা ক্রোল থ্রাস্ট এমনভাবে কাজ করেছে যে, রূপান্তরিত অবসাদী ক্রোল স্তরক্রমকে নিম্ন টার্শিয়ারি যুগের সুবাথু ও দাগশাই শিলাস্তরের উপর আরোপ করেছে।
আরও পূর্বদিকে, যমুনা নদীর পূর্বভাগে এম বি টি / ক্রোল থ্রাস্টের প্রভাবে ক্রোল স্তরক্রম সরাসরি শিবালিক স্তরের উপর আরোপিত হয়েছে। এই ভূতাত্ত্বিক সীমানা সুস্পষ্টভাবে মুসৌরি–ল্যান্সডাউন–নৈনিতাল পর্বতমালার পাদদেশে চিহ্নিত হয়েছে।
নেপালে এম বি টি শিবালিকের উপর ক্ষুদ্রতর হিমালয়ের মহাভারত পর্বতমালাকে ঠেলে তুলেছে। পূর্ব হিমালয়ে, কোশি নদীর ওপারে এই এম বি টি-র ঝুলন্ত প্রাচীর স্থানীয়ভাবে ‘গন্ডওয়ানা থ্রাস্ট’ নামে পরিচিত। এটি প্যালিওজোয়িক যুগের গন্ডওয়ানা (দামুদা/রংগিত/গারু) শিলাস্তর দ্বারা গঠিত, যা শিবালিক গোষ্ঠীর উপরে রয়েছে। উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত এই এম বি টি আসলে তীব্র বিকৃতি ও জটিল ভাঁজের এক বিস্ময়কর অঞ্চল, যেখানে একাধিক অভ্যন্তরীণ থ্রাস্ট রেখা একে অপরের উপর দিয়ে কাটাকুটি খেলেছে।
২. মেইন সেন্ট্রাল থ্রাস্ট
প্রাথমিক গবেষণায়, এম সি টি (MCT)-কে ধরা হতো ক্ষুদ্রতর হিমালয়ের রূপান্তরিত অবসাদী শিলা ও উত্তরের নিম্ন–মধ্য গ্রেডের ক্রিস্টালাইন শিলার মধ্যবর্তী সীমানা হিসেবে। পরে ভালদিয়া এটিকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করে নতুন নাম দেন মুন্সিয়ারি থ্রাস্ট।
কুমায়ুন অঞ্চলে গবেষণাকালে, ভালদিয়া নিম্ন–মধ্য গ্রেডের ক্রিস্টালাইন শিলাকে তিনটি গোষ্ঠীতে ভাগ করেন—জুটঘ, আলমোড়া, মুন্সিয়ারি। এই শিলাগুলি মুন্সিয়ারি থ্রাস্ট বরাবর (হিমাচলে জুটঘ থ্রাস্ট নামে পরিচিত) কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণ দিকে সরে এসে বড় ন্যাপ আকারে এবং ক্লিপ আকারে ক্ষুদ্রতর হিমালয়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। যথা-
উত্তর-পশ্চিম সম্প্রসারণ: কাশ্মীরে পীরপাঞ্জাল থ্রাস্ট।
পূর্ব সম্প্রসারণ: নেপালের অভ্যন্তরীণ ক্ষুদ্রতর হিমালয়ে নিম্ন-গ্রেড ক্রিস্টালাইন শিলার পাদদেশে।
দক্ষিণ-পূর্ব সম্প্রসারণ: সিকিম–ভুটানে পারো থ্রাস্ট, অরুণাচলে বোমডিলা থ্রাস্ট।
ভালদিয়া এম সি টি/ ভৈকৃত থ্রাস্ট-কে পুনঃসংজ্ঞায়িত করেন উচ্চ-গ্রেড ক্রিস্টালাইন শিলার (ভৈকৃত গ্রুপ) পাদদেশে, মুন্সিয়ারি গ্রুপের উত্তরে। তাঁর পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, মুন্সিয়ারি ও ভৈকৃত গ্রুপের মধ্যে রূপান্তর-গ্রেড ও খনিজ-সমষ্টিতে হঠাৎ ও স্পষ্ট পরিবর্তন রয়েছে। এই ফলাফল নেপালের গবেষণাতেও সমর্থিত।
পরবর্তী আধুনিক কাঠামোগত ও ভূ-ভৌত গবেষণা ভালদিয়ার সংজ্ঞায়িত এম সি টি, মুন্সিয়ারি থ্রাস্ট, রামগড় থ্রাস্ট, এম বি এফ ও এম বি টি-কে সাধারণত সমর্থন করেছে। যেমন, ভূগঠনগত ছেদচিত্র, যা বিকৃতির আগে ও পরে শিলাস্তরের আসল রূপ ও অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পুনর্গঠন করে দেখানো হয়। তবে কিছু গবেষক মনে করেন, মুন্সিয়ারি থ্রাস্টই প্রকৃত এম সি টি (এম সি টি-১) এবং ভৈকৃত থ্রাস্ট (এম সি টি-২) একটি পৃথক উত্তরের থ্রাস্ট।
সূত্র:
01) Khadg Singh Valdiya by SK Tandon ; Resonance Journal ; Indian Academy of Science (2021).
02) Geologist Valdiya honored by The Tribune(11 May, 2015).
03) The Journey of a Foot-Soldier Geologist by Jaishri Sanwal(JNCASR) ; Journal of Science Education (March, 2021)