মোনাশ ইউনিভার্সিটির টার্নার ইনস্টিটিউট ফর ব্রেন অ্যান্ড মেন্টাল হেলথের গবেষকদের নেতৃত্বে ১০,০০০০- এর বেশি মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে যে একজন ব্যক্তির মস্তিষ্কের সামগ্রিক আকৃতি আমরা কীভাবে চিন্তা করি, অনুভব করি তার উপর অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। এমনকি জটিল নিউরোনাল সংযোগের চেয়ে মস্তিষ্কের আকৃতি এই বিষয়ে অনেক বেশি প্রভাব ফেলে।
নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত এই গবেষণায় পদার্থবিজ্ঞান, নিউরোসায়েন্স এবং মনোবিজ্ঞানের প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়েছে, আগে মস্তিষ্কের নিউরনের যোগসূত্রের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হত, কিন্তু মস্তিষ্কের কাজের সাথে মস্তিষ্কের আকৃতির সম্পর্ক নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবা হত না। এই গবেষণা পুরনো ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
টার্নার ইনস্টিটিউট এবং মোনাশ ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ সাইকোলজিক্যাল সায়েন্সেসের প্রধান লেখক এবং রিসার্চ ফেলো ডক্টর জেমস প্যাং বলেছেন এই গবেষণার ফলাফল খুব উল্লেখযোগ্য, এই গবেষণা মস্তিষ্কের কাজ, তার বিকাশ এবং তাতে কীভাবে বয়সের ছাপ পড়ে তা অনেক সরলভাবে বর্ণনা করেছে। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, মস্তিষ্কে ডিমেনশিয়া, স্ট্রোকের কী প্রভাব পড়ে, তা জটিল স্নায়বিক যোগসূত্রের মডেলের সাহায্যে বোঝার থেকে, মস্তিষ্কের আকৃতি থেকে বোঝা অনেক সহজ।
আগে আমাদের ধারণা ছিল, নির্দিষ্ট ধারণা বা নির্দিষ্ট অনুভূতি মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে প্রকাশ পায়। কিন্তু এই গবেষণায় দেখা গেছে, সমগ্র মস্তিষ্ক এই ক্রিয়াকলাপে সাড়া দেয়। ভায়োলিন থেকে যখন সুর উৎসারিত হয়, তখন যেমন তারের পুরো কম্পনে সুরের একটা নোট সৃষ্টি হয়, তারের নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলে শুধুমাত্র সুরটা সীমাবদ্ধ থাকে না, এটা অনেকটা সেরকম।
গবেষকরা আইজেনমোডস নামে একটা পদ্ধতির সাহায্য নিয়েছেন, যা পদার্থবিদ্যা ও এঞ্জিনিয়ারিং – এর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, যেখানে একটা সিস্টেমের স্বাভাবিক কম্পন লক্ষ করা হয়, যেখানে পুরো সিস্টেমের প্রতিটা অংশ একই কম্পাঙ্কে আন্দোলিত হয়। এটা মস্তিষ্কের ক্ষেত্রে সম্প্রতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে ম্যাগনেটিক রেসোনেন্স ইমেজিং (MRI) – এর সাহায্যে আইজেনমোডস পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এই গবেষণায় মস্তিষ্কে সফলভাবে আইজেনমোডস কীভাবে সৃষ্টি করা যাবে তার দিকে মূল নজর দেওয়া হয়েছে।
ব্রেনকি এবং সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-প্রধান লেখক ডঃ কেভিন অ্যাকুইনো বলেছেন ভায়োলিনের তারের কম্পাঙ্কের অনুরণন, তার দৈর্ঘ্য, ঘনত্ব এবং টানের ওপর নির্ভর করে, তেমন মস্তিষ্কের আইজেনমোডস তার শারীরিক, জ্যামিতিক, আভ্যন্তরীণ শারীরস্থানের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু কোন বৈশিষ্ট্য এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা এখনও রহস্যাবৃত।
টার্নার ইনস্টিটিউট এবং স্কুল অফ সাইকোলজিক্যাল সায়েন্সেস ARC লরিয়েট ফেলো, প্রফেসর অ্যালেক্স ফরনিটোর নেতৃত্বে গবেষকরা, বিভিন্ন কার্যকলাপের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের আকৃতি থেকে পাওয়া আইজেনমোডস ও মস্তিষ্কের স্নায়বিক যোগসূত্র থেকে পাওয়া আইজেনমোডসের মধ্যে তুলনা করেছেন। প্রফেসর অ্যালেক্স ফরনিটো বলেছেন, মস্তিষ্কের জ্যামিতিক আকার , এর কনট্যুর ও খাঁজের জন্য যে আইজেনমোডস পাওয়া যায়, তা মস্তিষ্কের কাজের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী নির্ধারক। এক্ষেত্রেও তিনি আবার বাদ্যযন্ত্রের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ড্রামের আকার যেমন তার শব্দ কেমন হবে তা নির্ধারণ করে, মস্তিষ্কের আকার, খাঁজ সেই এক কাজ করে।
গাণিতিক মডেলের সাহায্যে তারা দেখেছেন, পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে তরঙ্গ বিস্তার লাভ করে, মস্তিষ্কের জ্যামিতিক আকার ও কাজের মধ্যে সম্পর্ককে চালনা করে। ঠিক পুকুরে একটা পাথর ফেললে যেভাবে ঢেউ ওঠে সেভাবে।
মস্তিষ্কের আকারের সাথে তার কাজের সম্পর্কের যোগসূত্র স্থাপন করা এই গবেষণা ব্যক্তিবিশেষের ব্যবহারে কী ফারাক, এবং কোনো ব্যক্তির কী ধরনের মানসিক বা স্নায়বিক সমস্যা হতে পারে তা নিয়ে নতুন দিশা দেখাতে পারে।