অশ্বথ, বট গাছেদেরও শুনলে হয়ত মন খারাপ হয়ে যাবে! কাঠঠোকরাকে বিলুপ্ত বলে ঘোষণা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার! হাতির দাঁতের মত ঠোঁট, রঙের অসাধারণ মিশ্রণে চোখধাঁধানো কাঠঠোকরাদের গত কয়েক দশক ধরে আমেরিকায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! একটা অশ্বথ গাছে কাঠঠোকরার বাসা! গাছটাও যেন পাখিদের তখন বলত, কত প্রাণী, উদ্ভিদের সঙ্গে তোমাদেরও আমি ধারণ করি!
ইউএস ফিশ এবং ওয়াইল্ড লাইফ সার্ভিসের কর্মীরা কয়েক দশক ধরে খুঁজে বেড়িয়েছেন এই পাখিদের। দেখতে পাননি। কোথাও দেখা যায়নি। আরকানসাস, লুইজিয়ানা, মিসিসিপি, ফ্লোরিডা, কোথাও কাঠঠোকরাদের দেখা যায়নি। শুধু কাঠঠোকরা নয়, তাদের সঙ্গে আরও ২২টি প্রজাতির পাখিকেও বিলুপ্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ওয়াইল্ড লাইফ সার্ভিসের কর্মীরা এবং একইসঙ্গে, সরকারি বিজ্ঞানীরাও বলে দিয়েছেন, তাদের পক্ষে আর খোঁজা সম্ভব হচ্ছে না! কাঠঠোকরা ছাড়াও ‘বিলুপ্ত’ হয়ে যাওয়া পাখিদের মধ্যে পিগটো, ঝিনুক পাখির মত আরও অনেক প্রজাতির পাখিও রয়েছে।
ইউএস ওয়াইল্ড লাইফ সার্ভিসের এক বায়োলজিস্ট অ্যান্ডি ফোর্ড স্মৃতিচারণ করছেন এই প্রসঙ্গে, “শেষ যেদিন দেখেছিলাম একটা কাঠঠোকরাকে, সেটাই মনে রাখার চেষ্টা করছি! আমিই হয়ত শেষজন যে শেষবারের মত একটা কাঠঠোকরাকে দেখেছিল!”
বিজ্ঞানীদের মনে হচ্ছে, ২৩ প্রজাতির পাখির বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বিশ্ব উষ্ণায়ন। কিন্তু তার সঙ্গে অন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণও দেখিয়েছেন প্রাণীবিদরা। যেমন, জল ও বাতাসে মাত্রারিক্ত দূষণ, জমে থাকা জলের আবর্জনা, অন্য প্রাণীর আক্রমণ এবং সর্বোপরি পাখির পালক ও মাংস নিয়ে ব্যবসার জন্য মানুষের পাখি-বধ। বিজ্ঞানীদের মতে শেষপর্যন্ত আমেরিকায় ২৩টি প্রজাতির পাখির বিলুপ্তির নেপথ্যে রয়েছে সেই মানুষ!
১৯৬০-এ যখন বিপন্ন প্রজাতির তালিকা মার্কিন সরকার তৈরি করেছিল তখন এই ২৩টি বিপন্ন প্রজাতির পাখিদেরও ওই তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করে হয়েছিল। প্রাণীবিদরা ভেবেছিলেন, তালিকায় অন্তর্ভূক্ত যখন হয়েছে তখন হয়ত কাঠঠোকরাদেরও ভাগ্য ফিরবে। কিন্তু তাদের ভাবনা শেষপর্যন্ত ভাবনাতেই থেকে গেল।
এ-তো গেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা। গোটা পৃথিবীর দিকে তাকালে পরিসংখ্যানও বড় হয়ে যাবে। প্রাণীবিদদের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, ৯০২টি প্রজাতির প্রাণীকে বিলুপ্ত বলে ঘোষণা করা হয়ে গিয়েছে।
কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাখি বিশেষজ্ঞ জন ফিজপ্যাট্রিকের মনে হয়েছে, বিলুপ্ত বলে ঘোষণা একবার করে দিলে লাভের চেয়ে কিন্তু ক্ষতি বেশি হয়। বিলুপ্ত বলে আমরা আমাদের দায় এড়িয়ে গেলাম! জন বলেছেন, “২০০৫ সালে আরকানসাসের পূর্বে কাঠঠোকরা পাওয়া গিয়েছিল দু’একটা। তারপর থেকে তাদের কতটা লালনপালন করা হয়েছে? তাদের বংশবৃদ্ধির ব্যবস্থা কি আদৌ করা হয়েছিল?” আর এক প্রাণীবিদ হিলটন টেলারেরও গুরুতর অভিযোগ প্রানী ও উদ্ভিদের বিলুপ্তি নিয়ে। তার বক্তব্য, “প্রচুর মিলিয়ন ডলার ধার্য করা হয় প্রত্যেক বছর, বিলুপ্ত প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ খুঁজে বার করার জন্য। কিন্তু খোঁজাখুঁজি কিছুদিন ধরে চলার পর আমরা দেখি, টাকাটা হঠাৎ ‘অদৃশ্য’ হয়ে যায়! কীভাবে হয় জানি না! তখন খোঁজাখুঁজিও বন্ধ হয়ে যায়। তারপর ১৫-১৬ বছর পর হঠাৎ সরকার বলে দেয় এই প্রাণীগুলো, উদ্ভিদ বিলুপ্ত!”
সুইৎজারল্যান্ডের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা আছে, যাদের কাজই বিলুপ্ত বলে ঘোষিত প্রাণী ও উদ্ভিদদের খুঁজে বার করা। হিলটন টেলার এই সংস্থারই ডিরেক্টর। তাদের তালিকায় কিন্তু কাঠঠোকরা এখনও ‘বিলুপ্ত’ হয়নি! তাদের দাবি, কিউবায় কিন্তু কাঠঠোকরাকে পাওয়া গিয়েছে।
পৃথিবীতে ওয়াইল্ড লাইফ পপুলেশন ১৯৭০-এর পর থেকে এখনও পর্যন্ত ৬৮ শতাংশ কমে গিয়েছে। ১৯৭৫-এর পর থেকে ৫৪টি প্রজাতির প্রাণী ‘বিপন্নদের’ তালিকায় চলে গিয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম পালকহীন ঈগল, বাদামি পেলিকান আর কুঁজো তিমি। প্রাণীবিদরা বলছেন বিশ্ব উষ্ণায়নে বন্যা, খরা, দাবানল তাপ প্রবাহের মাত্রা এত বেড়ে যাচ্ছে যে, বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীদের উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
বিশ্ব জুড়ে প্রাণীবিদদের আক্ষেপ, বিপন্নদের তালিকা আগামিদিনে আরও বাড়বে। জন ফিজপ্যাট্রিকের মত অনেক প্রাণীবিদ ভাবছেন তাদের বাকি জীবনের অধিকাংশ সময়টা হয়ত কাটবে, কাঠঠোকরা, ঝিনুক পাখি বা বাদামী পেলিকানদের নিয়ে শুধুই স্মৃতিচারণ করে!