বাইপোলার ডিসঅর্ডারের চিকিৎসায় আশার আলো

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের চিকিৎসায় আশার আলো

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৩ মার্চ, ২০২৪

ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস-এর (এনসিবিএস) গবেষকদের দ্বারা পরিচালিত একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছে কীভাবে লিথিয়াম মস্তিষ্কের কোশগুলোতে স্নায়বিক কার্যকলাপ পরিবর্তন করতে কাজ করে। এনসিবিএস-এর মতে এই গবেষণা বাইপোলার ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে নতুন চিকিত্সা এবং নির্ভুল ওষুধের তৈরির একটি সম্ভাব্য পথ প্রস্তাব করতে পারে। সারা বিশ্বে কর্ম ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া বা হারিয়ে যাওয়া মানুষের মধ্যে বাইপোলার ডিসঅর্ডার ষষ্ঠ প্রধান কারণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও লিথিয়ামের মতো মুড স্টেবিলাইজার এই ক্ষেত্রে মস্তিষ্ককে প্রশমিত করার জন্য ব্যবহারযোগ্য চিকিত্সা, কিন্তু শুধুমাত্র এক-তৃতীয়াংশ রোগী লিথিয়াম চিকিত্সা দ্বারা উপকৃত হয়। এটি মস্তিষ্কের অতিসক্রিয়তাকে বা রোগীর মানসিক অস্থিরতাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত অবশিষ্ট রোগীরা লিথিয়াম চিকিত্সার জন্য সীমিত বা কোন প্রতিক্রিয়াই দেখায় না।
মনের এক জটিল অসুখ, বাইপোলার ডিসঅর্ডার। এর লক্ষণ বড়োই অদ্ভুত। কখনও মন আনন্দে উৎফুল্ল, কখনও আবার অবসাদে আচ্ছন্ন। কখনও আবার মন এতটাই খারাপ যে বিছানা ছেড়ে ওঠা মুশকিল হয়ে যায় রোগীর। বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত রোগীদের মানসিক স্থিতি ফেরাতে প্রধান ওষুধ লিথিয়াম। সমস্যা হল, এটি রোগ নিরাময়ে কিছু ক্ষেত্রে কাজ দিলেও, ঠিক কী ভাবে কাজ করে, তা অজানা ছিল। এতে কোন রোগীর ক্ষেত্রে লিথিয়াম কাজ করে, আর কার ক্ষেত্রে নয়, সেটা বুঝতে সময় লেগে যায়। এই সমস্যার সমাধান করেছেন ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিকাল সায়েন্সেস-এর এক দল গবেষক। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে ‘লায়েফ সায়েন্স অ্যালায়েন্স’ নামক জার্নালে। মস্তিষ্কে, কোশের মধ্যে যোগাযোগ নিউরোট্রান্সমিটার নামক রাসায়নিকের মাধ্যমে ঘটে যার ফলে আমরা স্বাভাবিকভাবে আচরণ করে থাকি। সেরোটোনিন বা গ্লুটামেট নামের এই নিউরোট্রান্সমিটার কোশের ঝিল্লির রিসেপ্টরের সাথে আবদ্ধ হয় যা ফসফোলিপেস সি (পিএলসি) নামক একটি এনজাইমকে চালু করে। পিএলসি-র ভূমিকা হল লিপিড অণু-ফসফ্যাটিডাইলিনোসিটল ৪,৫-বিসফসফেট (পিআইপি২) কে ইনোসিটল ১,৪,৫-ট্রিসফসফেট-এ (আইপি৩) ভেঙে দেওয়া যা কোশের মধ্যে ক্যালসিয়ামের মাত্রার পরিবর্তনে সাহায্য করে। ক্যালসিয়াম মস্তিষ্কের মধ্যে অনেক কাজ সম্পাদন করে এবং স্নায়ু কোশের মধ্যে ক্যালসিয়ামের মাত্রার পরিবর্তন বাইপোলার ডিসঅর্ডারের একটি সম্ভাব্য ভিত্তি। লিথিয়ামের স্থিতিশীল প্রভাব বোঝার জন্য, গবেষকরা পরীক্ষাগারে তৈরি করা কর্টিকাল কোশকে নিউরোট্রান্সমিটার দিয়ে চিকিত্সা করেছিল। তারা দেখেন এটি একটি বাইপোলার মস্তিষ্কের অতিরিক্ত উদ্দীপিত কোশের অনুকরণ করে পিএলসিকে সক্রিয় করে। লিথিয়াম যোগ করলে দেখা যায় পিআইপি২-এর পুনরায় সংশ্লেষণে বিলম্ব ঘটছে। ফলস্বরূপ, এটি আইপি৩ গঠনের গতি কমিয়ে দেয় এবং ক্যালসিয়ামের প্রবাহ হ্রাস করে যা নিউরনের কার্যকলাপকে কমিয়ে দেয়। গবেষকদের দাবি যে, ‘ফসফ্যাটিডাইলিনোসিটল সিগন্যালিং’-এর দ্বারা একটি নির্দিষ্ট লিপিড, পিপ২-এর পরিমাণকে নিয়ন্ত্রণ করে সম্ভবত লিথিয়াম মস্তিষ্কের অতিসক্রিয়তা কমিয়ে তাকে শান্ত করে। গবেষকদের আশা, লিথিয়ামের এই কার্যপদ্ধতি জানা যাওয়ায় ভবিষ্যতে চিকিৎসা শুরুর আগেই বোঝা যাবে, কোন রোগীর ক্ষেত্রে লিথিয়াম কাজ করবে, কার ক্ষেত্রে করবে না। বিকল্প চিকিৎসা খুঁজতে হবে। মস্তিষ্কের কোশগুলোর উপরে লিথিয়াম কী ভাবে কাজ করে, তা পরিষ্কার ভাবে জানা গেলে আগামী দিনে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হবে। তবে রোগ এক হলেও বিভিন্ন মানুষের সমস্যা আলাদা, ফলে নিরাময়ের পথও আলাদা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × 1 =