ছোট্ট এক পাখির স্মৃতিশক্তি বারকোডের মতো বিন্যস্ত

ছোট্ট এক পাখির স্মৃতিশক্তি বারকোডের মতো বিন্যস্ত

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৩ এপ্রিল, ২০২৪

উত্তর আমেরিকার বহুল পরিচিত প্রজাতির এক ধরনের ছোটো পাখি হল চিকাডি। এই পাখিদের বড়ো গোলাকার মাথা, ক্ষুদ্র শরীর কিন্তু এদের যাবতীয় বিষয়ে কৌতূহল থাকে। চিকাডিরা “চিক-এ-ডি-ডি-ডি” ডাক দিয়ে সম্ভাব্য শিকারীর উপস্থিতি সম্পর্কে একে অন্যকে সতর্ক করে। এই ডাকই তাদের নামকরণের উৎস। এরা পোকা মাকড়, নানা গাছের বীজ দানা খেয়ে থাকে। কিন্তু এই ছোটো পাখিদের স্মৃতি শক্তি গবেষকদের অবাক করে দিয়েছে। আনেক চিকাডি ঠাণ্ডাতে অন্যস্থানে উড়ে যায় না, নিজেদের জায়গাতেই থাকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল তারা তাদের গরম কালের এপিসোডিক মেমরি অর্থাৎ নির্দিষ্ট মুহূর্তগুলি স্মরণ করে, তাদের গাছের বাকলের নীচে বা কোনো গাঁটের মধ্যে লুকোনো খাবার মনে করে খুঁজে বের করতে পারে। মস্তিষ্কের এই ক্ষমতা কিন্তু তাদের শীতকালে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। গরমের মাসগুলোতে কোথায় খাবার লুকিয়েছিল সেটা মনে রাখার ওপর তাদের প্রচন্ড ঠাণ্ডায় যখন খাবার অপ্রতুল তখন তাদের বাঁচতে সাহায্য করে, কোনো কোনো চিকাডি গরমে প্রতিদিন ৫০০০ দানা খাবারও জমা করে।
চিকাডির স্মৃতিশক্তি আগেও বিজ্ঞানীদের বিস্ময় উদ্রেক করেছে। কলম্বিয়ার মর্টিমার বি জুকারম্যান মাইন্ড ব্রেন বিহেভিয়ার ইনস্টিটিউটের ডঃ দিমিত্রি আর্নভ নিউরাল রেকর্ডিং আর আচরণ ট্র্যাক করার সরঞ্জাম ব্যবহার করে দেখতে চেয়েছিলেন এই পাখিদের স্মৃতি কীভাবে তৈরি হচ্ছে। তিনি ও তার সহকর্মীরা গবেষণাগারের অন্দরের মেঝে জুড়ে বহু সংখ্যক কুলুঙ্গি ছড়িয়ে রেখে, তাতে খাবার হিসেবে সূর্যমুখী বীজ রাখেন। প্রতি তাক আচ্ছাদিত করা হয়, যাতে পাখিদের মনে রাখতে হয় কোন স্থানে তাদের বীজ রয়েছে আর কোনটা খালি। পাখিরা কুলুঙ্গির মধ্যে ঘুরে বেড়াতে পারে, বীজ লুকিয়ে রাখতে পারে আর পরে পুনরুদ্ধার করতে পারে যেমন তারা প্রকৃতিক স্থানে করতে অভ্যস্ত। ৬টা লুকানো ক্যামেরা পাখিদের কার্যকলাপে নজরদারি করে। এই রেকর্ডিংগুলিকে তারপরে একটি কম্পিউটার অ্যালগরিদমে ফিট করানো হয় যা পাখিদের বীজ জমা করা, বীজ পুনরুদ্ধার ট্র্যাক করে। একটা চিকাডি সূর্যমুখীর বীজ নিয়ে তার স্বভাববশত একটা গর্তে নিয়ে লুকোলো। ঠিক তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ৬টা ক্যামেরা তাকে ট্র্যাক করতে লাগল। গবেষকরা দেখেন, যখনই চিকাডি একটা বীজ লুকিয়ে সঞ্চয় করছে, তার হিপোক্যাম্পাস অঞ্চলের নিউরন অনন্যভাবে মাত্র এক সেকেন্ড সময়ের জন্য ফ্ল্যাশ করছে। আর যখন পরে চিকাডি সেই নির্দিষ্ট খাবারের দানা খুঁজতে যাচ্ছে আবার নিউরনে সেই মুহূর্ত ফিরে আসছে। চিকাডির তথ্য নিয়ে কাজ করার সময় গবেষকদের মাথায় বিভিন্ন ইভেন্টের অনন্য লেবেল হিসেবে নিউরাল বারকোডের ধারণা আসে। এই বারকোড প্যাটার্নগুলো হিপ্পোক্যাম্পাল নিউরনের কার্যকলাপ থেকে স্বাধীনভাবে প্লেস সেল-এ পাওয়া যায়। প্লেস সেল অবস্থানের স্মৃতি এনকোড করে। প্রতিটি বারকোড স্বতন্ত্র, একই স্থানে বিভিন্ন সময়ে লুকোলেও কিন্তু প্রত্যেকটা দানার জন্য বারকোড আলাদা হয়।
মানুষের ক্ষেত্রেও হিপোক্যাম্পাস বস্তু, স্থান এবং স্মৃতির মাধ্যমে পৃথিবীকে দেখে তার সাথে আদানপ্রদান করে। সেল জার্নালে চিকাডির ওপর অধ্যয়নে মেমরির বারকোড-সদৃশ যে বিন্যাস প্রকাশিত হয়েছে, গবেষকরা বলেছেন এটা মানুষের মস্তিষ্ক ও অন্যান্য প্রাণীদের মস্তিষ্কের সাধারণ কৌশল হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

six + two =