বিজ্ঞান ভাবনা কি স্বাধীন হয়েছে?

বিজ্ঞান ভাবনা কি স্বাধীন হয়েছে?

অভিজিৎ চৌধুরী
Posted on ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১

ভারতবর্ষ এমন এক দেশ যেখানে বৈচিত্র্যের অভাব নেই। বৈচিত্র্য সংস্কারে, বৈচিত্র্য সংস্কৃতিতে, বৈচিত্র্য ভাষায়। এখনও হাজারো রকমারি কুসংস্কার। এদেশের কোনো অঞ্চলের মানুষ এখনও বিশ্বাস করেন, মৃন্ময় গনেশ দুগ্ধ সেবন করেন, কোনো অঞ্চলের মানুষ এখনও মনে করেন, সতীদাহ প্রথা জিইয়ে রাখাটা পুণ্যের কাজ, আবার অনেক জায়গার মানুষ মনে করেন – বিষধর সাপে কামড়ালে ঝাড়ফুঁকেই ভিক্টিম বেঁচে ওঠে, নইলে তাকে বৈতরণীতে ভাসিয়ে দিতে হয়।

আমরা সবাই জানি, ইউরোপীয় সভ্যতার হাত ধরেই ভারতের আধুনিকতার আলো পাওয়া। আলো-পাওয়া মানে এনলাইটেনমেন্ট, বিজ্ঞান ও যুক্তিকে সামনে রেখে বেঁচে থাকা ও বাঁচিয়ে রাখা। এখন যাকে আমরা আধুনিক বিজ্ঞান বলি – সেই চর্চাও ইউরোপীয়দের হাত ধরেই এসেছিল এদেশে। আমাদের দেশেরও নিজস্ব চর্চার জায়গা ছিল বটে কিন্তু তা “আধুনিক” ছিল না। তারাশঙ্করের আরোগ্য নিকেতন মনে করুন। সে-গল্প সনাতন কবিরাজি প্রথা বনাম আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের বোঝাপড়ার। ভারতে যে সমস্ত প্রাচীন চর্চা ছিল, সেগুলোর প্রায় কোনোটাই আধুনিক বিজ্ঞানে স্থান পায় নি। এমনকি ব্যাকরণ চর্চার ক্ষেত্রেও যে ঐতিহ্যের দেশ এই ভারত, সে ঐতিহ্য আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের থেকে আলাদা। অনেক বিষয়ে ভেতরে ভেতরে মিল থাকা সত্ত্বেও। অর্থাৎ, ভারতীয় চর্চার চরিত্র আধুনিক চর্চার চরিত্রের থেকে আলাদা ছিল। দৃষ্টান্ত দিলেই জিনিসটা বোঝা সহজ হবে। আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে অনুমান প্রমাণ নয়, কিন্তু ভারতীয় ন্যায়শাস্ত্রে তো বটেই, আয়ুর্বেদশাস্ত্রেও অনুমানের গুরুত্ব ছিল সাংঘাতিক।

কিন্তু আজকের প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। যেভাবেই হোক, ভারতীয় চিন্তায় আধুনিক বিজ্ঞানের ছোঁয়া তো লেগেইছিল সেই উপনিবেশের আমলে। ভারতে অনেক পণ্ডিত মানুষ আধুনিক বিজ্ঞানচর্চায় অংশগ্রহণও করেছেন। কিন্তু আজ ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতার ৭৬ বছরের মাথায় এসে আমাদের মনে সংশয় জাগে, আমরা কি সত্যিই বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এমন কোনো বিশেষ অবদান রাখতে পেরেছি; ভারতীয় সমাজে সরাসরি যার ফলশ্রুতি ঘটতে পারে!

বিজ্ঞানের সরাসরি চর্চা করা আর বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হয়ে ওঠার মধ্যে কিন্তু ফারাক আছে। যেমন ফারাক আছে গণিত জানা আর গাণিতিক মন তৈরি করার মধ্যে। একজন শিল্পী, চিত্র শিল্পীর কথাই ধরা যাক। তিনি যখন কোনো ছবি আঁকেন, তখন তাঁর প্রতিটা আখরে-টানে গণিতের সূত্র নিহিত থাকে, কিন্তু তাই বলে তাঁকে গণিতের সমীকরণ জানতে হয় না। আমাদের বিজ্ঞানভাষ যখন ত্রৈমাসিক বেরোতো, তখনও যেমন, বিজ্ঞানের প্রসার সকল মানুষের মধ্যে হোক – এই চেতনা আমাদের কর্মীদের মধ্যে কাজ করত, এখনও দৈনিক হিসেবে তার আত্মপ্রকাশের শুরু থেকেই – তেমন চেতনাই জাগরুক রয়েছে।

ভারতবর্ষে বিজ্ঞানের অগ্রগতি বলতে যা বোঝায় – তা মূলত তিনভাবে কাজ করে এসেছে শুরু থেকে। এক, জ্ঞানতাত্ত্বিক বিজ্ঞানচর্চা, দুই হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে উন্নত করা আর তিন, কুসংস্কার বা কুপ্রথা নিবারণে সমাজকে সচেতন করে তোলা। তৃতীয় কাজটাই ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা ঘটিয়েছে বললে অত্যুক্তি করা হয় না। রামমোহনের সতীদাহ, বিদ্যাসাগরের বাল্যবিবাহ রোধ, ইত্যাদি আইন প্রণয়ন – সেই কাজের কথাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়। অথচ, আজও সেই কাজ জ্ঞানচর্চার মহলে বা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে খুব একটা মর্যাদা পায় না। কেন?

জওহরলাল নেহরু রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বিজ্ঞানচর্চার কেন্দ্র তৈরি বা নদীতে বাঁধ দেবার কথা যেভাবে উপলব্ধি করেছিলেন – সেভাবে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতির ঘটেছে বলে ধরা হয়। নেহরুর উদ্যোগে বৈজ্ঞানিক গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রায় ৫০টি জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় স্বাধীনতার পরেই। এই উদ্যোগকে আমরা গর্বের সঙ্গেই মনে রাখছি। কিংবা মনে রাখছি সত্যেন্দ্রনাথ বসু বা জগদীশচন্দ্র বসুর মতো মানুষের বৈজ্ঞানিক কাজের অবদানকে অথবা রামানুজনের মতো গাণিতিক প্রতিভাকেও। সেইসঙ্গে মনে রাখব, কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে সি সুভ্রমনিয়মের কথাও, যাঁর কৃতিত্বে, এক ধাক্কায় ১৯৬২ সালে, কৃষিজাত খাদ্য-উৎপাদন ৩৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানবোধ, যুক্তিনিষ্ঠতা কতটা গড়ে উঠল এই ৭৬ বছরে – সে-কথাও মনে হয় হিসেবের মধ্যে রাখা দরকার। না-হলে রামানুজনের মতো শ্রেষ্ঠ প্রতিভারও ম্লেচ্ছ খাবার না-খাওয়ার ফল হিসেবে বিজ্ঞানের এন্তেকাল ঘটবে – যা খুবএকটা সুখের নয় বলেই মনে হয়। কী বলেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eighteen − thirteen =