ঘরের কাছের প্রতিবেশী প্রক্সিমা বি

ঘরের কাছের প্রতিবেশী প্রক্সিমা বি

Posted on ৮ এপ্রিল, ২০১৯

গত ২৪শে আগস্ট ইউরোপিয়ান সাদার্ন অবজার্ভেটরি ঘোষণা করেছে আমাদের সবচেয়ে কাছের যে তারকা প্রক্সিমা সেন্টরি (বা সেন্টরাই, যেমন খুশি উচ্চারণ বেছে নিন), তার চারপাশে একটা গ্রহ খুঁজে পাওয়া গেছে। গ্রহটার নাম দেওয়া হয়েছে প্রক্সিমা বি। বিভিন্ন কারণে এই আবিষ্কারের খবরটা কিছুটা আলোড়ন তুলেছে, খবরের কাগজের প্রথম পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। এটা শুধু যে সৌরজগতের বাইরে আমাদের সবচেয়ে কাছের গ্রহ তা নয়, এর তাপমাত্রাও সম্ভবত এমন যে এর পৃষ্ঠে জল তরল অবস্থায় থাকার সম্ভাবনা আছে। পৃথিবী ছাড়া সৌর জগতের অন্য কোথাও প্রাণের সন্ধান আমরা পাইনি। তাই তরল জল থাকার সম্ভাবনা শুনলে আমদের আগ্রহ জাগে কারণ তার মানে এই গ্রহে হয়তো প্রাণ সৃষ্টির অনুকূল পরিস্থিতি থাকতে পারে।

মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যে সৌরজগতের বাইরে গ্রহ, সংক্ষেপে বহির্গ্রহ, সম্পর্কে আমাদের ধারণা পুরোপুরি পালটে গেছে। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখনও পর্যন্ত সৌরজগতের বাইরে কোনো গ্রহের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তত্ত্ব আর কল্পবিজ্ঞানের মধ্যেই তারা সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৯২ সালে বিজ্ঞানীরা প্রথম ঘোষণা করেন যে পাওয়া গেছে, সূর্য ছাড়া অন্য কোনো নক্ষত্রের চারপাশে আবর্তনরত গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে। অবশ্য তার চার বছর আগে অন্য এক তারকাতে গ্রহ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছিল, তবে নিশ্চিত হয়ে বিজ্ঞানীরা বলতে পারেননি। সেই নিশ্চিত হতে লেগে গিয়েছিল প্রায় পনের বছর – ততদিনে আরও অনেক বহির্গ্রহ খুঁজে পাওয়া গেছে।

বহির্গ্রহের সন্ধান কেমন করে পাওয়া যায়? সূর্য ছাড়া বাকি সব নক্ষত্রই আমাদের থেকে এত দূরে যে তাদের কাছে কোনো গ্রহ আছে কিনা বোঝা সহজ নয়। গ্রহদের নিজের আলো নেই, নক্ষত্রের ঔজ্জ্বল্যের পাশে তাদের দেখা যায় না; ঠিক যেমন দিনের বেলা সূর্যের আলোতে আমরা চাঁদতারকাদের দেখতে পাই না। সেজন্য অন্য কয়েকটা পদ্ধতি কাজে লাগাতে হয়। তারকার বেগের পরিবর্তন মাপা তার মধ্যে একটা । তারকা যেমন মাধ্যাকর্ষণের সাহায্যে গ্রহকে টানে, গ্রহও তেমনি তারকাকে আকর্ষণ করে। গ্রহের ভর কম বলে তার চলাফেরা দেখা সহজ। কিন্তু গ্রহের আকর্ষণের জন্য নক্ষত্রও নড়াচড়া করে। সূর্যের ক্ষেত্রেও এটা হয়, তবে গ্রহদের ভর কম বলে সূর্যের এই বেগটাও কম। সূর্যের টানে পৃথিবী আবর্তন করছে, তার আবর্তন বেগ হল সেকেণ্ডে তিরিশ কিলোমিটার। পৃথিবী সূর্যের থেকে তিনশো তিরিশ লক্ষ গুণ হালকা, তাই পৃথিবীর টানে সূর্য প্রতি সেকেণ্ডে নয় সেন্টিমিটার সরে যায়। বোঝা যাচ্ছে নিশ্চয় যে কোটি কোটি কিলোমিটার দূর থেকে তারকাদের এই নড়াচড়া মাপা বেশ শক্ত। কেমন করে তারকার বেগ মাপা হবে?

তারকার বেগ আমরা তারকার বর্ণালী থেকে ডপলার ক্রিয়ার সাহায্যে মাপতে পারি। ডপলার ক্রিয়া কী? রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন, দূর থেকে একটা মেল ট্রেন হুইসল দিতে দিতে আসছে। যখন আপনার দিকে আসছে তখন, তার স্বরগ্রাম বেশি। যখন আপনার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, স্বরগ্রাম কমে যায়। ট্রেনের বেগের উপর স্বরগ্রামের ওঠাপড়া নির্ভর করে। ঠিক তেমনি আলোর কম্পাঙ্কের পরিবর্তন মেপে আলোক উৎস আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে না কাছে আসছে, তার বেগ কত, এ সমস্ত মাপা যায়। তবে গ্রহ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বিষয়টা আরও জটিল। আমাদের ছায়াপথে কোনো তারকাই স্থির নয়, প্রায় সমস্ত তারকাই আমাদের থেকে হয় দূরে সরে যাচ্ছে নয়তো কাছে আসছে। গ্রহ থাকলে তার প্রভাবে এই দূরে সরে যাওয়া বা কাছে আসার বেগটা সময়ের সঙ্গে পালটে যায়। এই বেগ পরিবর্তন থেকে গ্রহটার ভর, তারকার পাশে এক বার ঘুরতে তার কত সময় লাগে, কেন্দ্রের নক্ষত্রটার থেকে তার দূরত্ব কত – এ সমস্ত খবর পাওয়া যায়।

আমাদের সৌরজগৎ থেকে কোনো তারকা যত দূরে থাকে, সাধারণত আমাদের সাপেক্ষে তার বেগ তত বেশি হয়। ফলে গ্রহের টানে তার বেগের পরিবর্তন মাপা শক্ত হয়ে পড়ে। আবার গ্রহটা যত ভারি হয় বা নক্ষত্রের যত কাছে থাকে, নক্ষত্রের উপর তার আকর্ষণ বল তত বেশি। নক্ষত্রের আলোর ডপলার অপসরণ মাপা তত সোজা। তাই প্রথম প্রথম আমরা আমাদের কাছাকাছি তারকাতে খুব ভারি গ্রহগুলোকেই খুঁজে পাচ্ছিলাম। আমাদের মাপার পদ্ধতি যত উন্নত হয়েছে, তত আমরা আরও বেশি করে গ্রহ খুঁজে পেয়েছি।

আরও একটা পদ্ধতিতে অনেকগুলো বহির্গ্রহের সন্ধান মিলেছে। নক্ষত্র আর আমাদের পৃথিবীর মাঝে একটা সরলরেখা কল্পনা করুন। ঐ নক্ষত্রের কোনো গ্রহ থাকলে, এবং যদি সে ওই সরলরেখাটাকে ছেদ করে, তাহলে গ্রহণের মতো একটা পরিস্থিতি হবে। সেক্ষেত্রে তারকা থেকে আসা আলোর পরিমাণ কমে যাবে। এঁর থকে আমরা যে শুধু গ্রহের অস্তিত্ব বুঝতে পারি তা নয়, তার বছরের দৈর্ঘ্য এবং সেটা কত বড় তাও বুঝতে পারি।

এই দুটি পদ্ধতিই সবচেয়ে বেশি বহির্গ্রহ খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে। এ বছর আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রথম পদ্ধতিতে ৬৮৮-টা এবং দ্বিতীয় পদ্ধতিতে ২৬৭৮-টা বহির্গ্রহ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আরও কয়েকটি পদ্ধতি আছে তবে সেগুলো প্রয়োগের সুযোগ এখনো পর্যন্ত আরও কম। সব মিলিয়ে এ বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত আবিষ্কৃত বহির্গ্রহের মোট সংখ্যা ৩৫১৮। এই হিসাবটা exoplanet.eu ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া। NASA-র বহির্গ্রহের তালিকায় ৩৩৭৫-টা নাম আছে। প্রথম বহির্গ্রহ আবিষ্কারের পঁচিশ বছরের মধ্যে আমরা অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি সন্দেহ নেই।

গ্রহ থাকলেই তাতে প্রাণ থাকবে এমন কথা বলা যায় না। আগেই বলেছি সৌরজগতে পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও প্রাণের সন্ধান এখনো মেলেনি। তাই পৃথিবীর বাইরে প্রাণ, বিশেষ করে উন্নত জীব থাকতে পারে কিনা, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ্ররা একমত নন। তবে যে কোনো গ্রহে প্রাণ থাকার জন্য একটা শর্ত যে পূরণ করতে হবে সে কথা প্রায় সকলেই বলেন। সেখানে তাপমাত্রা একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকতে হবে যাতে সেখানে জল তরল অবস্থায় পাওয়া যাবে। তাপমাত্রা কম হলে জল জমে বরফ হয়ে যাবে, আর বেশি হলে জল বাষ্পে পরিণত হবে। এই দুই পরিস্থিতিতেই প্রাণ সৃষ্টির কোনো উপায় আমরা কল্পনা করতে পারি না, কারণ আমাদের জানা সমস্ত জৈবরাসয়ানিক বিক্রিয়াই জলীয় মাধ্যমে ঘটে। আর যদি এককোশী জীবের থেকে জটিল কোনো জীব জন্ম হতে হয়, তাহলে বহির্গ্রহটাকে হতে হবে পৃথিবী, শুক্র, মঙ্গল বা বুধের মতন পাথুরে। বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস বা নেপচুনের মতো গ্যাস দানব গ্রহে উন্নত জীব সৃষ্টি শক্ত।

এই দুই শর্তে দেখা যাবে আমাদের খুঁজে পাওয়া অধিকাংশ বহির্গ্রহেই উন্নত প্রাণ সৃষ্টির জন্য অনুকূল পরিবেশ নেই। তার কারণ এখনো পর্যন্ত আমরা সাধারণত নক্ষত্রের কাছের বড় গ্রহগুলোকে বেশি সংখ্যায় খুঁজে পেয়েছি। এর মানে এই নয় যে অধিকাংশ গ্রহই বড় এবং নক্ষত্রের কাছাকাছি থাকে। এ ধরনের গ্রহগুলোকে খুঁজে পাওয়া সহজ বলে আমরা এদের কথাই বেশি জানি। তাই নতুন গ্রহ প্রক্সিমা সেন্টরি বি-র আবিষ্কার বিজ্ঞানী মহলে আগ্রহের সঞ্চার করেছে। দেখা যাক এর সম্পর্কে আমরা কী জানি।
প্রথমেই ধরা যাক এই গ্রহটা যে তারকাকে ঘিরে আবর্তন করছে তার কথা। প্রক্সিমা সেন্টরি হল আমাদের সবচেয়ে কাছের তারকা, আমাদের থেকে মাত্র ৪.২ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। আলফা সেন্টরি নক্ষত্রমণ্ডলীতে তিনটি নক্ষত্র আছে, তাদের মধ্যে একটি প্রক্সিমা। তবে প্রক্সিমা আলফা সেন্টরির স্থায়ী সদস্য না অতিথি তা আমরা এখনো জানি না। এর ভর সুর্যের ভরের মাত্র তের শতাংশ, পরিভাষায় এটি একটি লাল বামন নক্ষত্র। লাল বামনদের ভর সূর্যের ভরের মোটামুটি নয় থেকে পঞ্চাশ শতাংশের মধ্যে হয়, তার মানে এই নক্ষত্রকূলের মধ্যেও প্রক্সিমার ভর কম। আর একটু কম হলেই এ আর কোনোদিনই তারকা হয়ে জন্মাতে পারত না। লাল বামন নক্ষত্ররা খুব অনুজ্জ্বল হয়, প্রক্সিমার ঔজ্জ্বল্য সূর্যের দুই শতাংশেরও কম। আমাদের সবচেয়ে কাছের তারকা হওয়া সত্বেও এত মিটমিটে বলে আমরা খালি চোখে প্রক্সিমাকে দেখতে পাই না। নক্ষত্রটা আবিষ্কার হয় একশ বছর আগে ১৯১৫ সালে দূরবিনের সাহায্যে। আমরা জেনেছি যে তার ব্যাসার্ধ হল এক লক্ষ কিলোমিটার। তুলনা করলে আমাদের সূর্যের ব্যাসার্ধ সাত লক্ষ কিলোমিটার।

প্রক্সিমার ভর কম বলে তার কাছের গ্রহের টান তাকে সহজেই বিচলিত করতে পারে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন তার বেগ যে ভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পালটাচ্ছে তা ব্যাখ্যা করতে গেলে ধরে নিতে হবে তার চারপাশে একটা গ্রহ আছে। গ্রহটা তাকে ১১.২ দিনে একবার প্রদক্ষিণ করছে। নতুন গ্রহটার জন্য নক্ষত্রটা সেকেণ্ডে দুই মিটারের কাছাকাছি সরে যায়। তারকার ভর আমরা আগেই বার করেছিলাম, তাই গ্রহদের গতবিধি সংক্রান্ত কেপলারের সূত্র ব্যবহার করে দেখা গেল তারকা থেকে গ্রহটার দূরত্ব হল মাত্র সাড়ে বাহাত্তর লক্ষ কিলোমিটার। আমাদের সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ বুধ সূর্যের থেকে প্রায় পাঁচ কোটি আশি লক্ষ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গ্রহটার ভরের পাল্লাটাও জানা গেল। দেখা গেল তার ভর কম হলে পৃথিবীর থেকে সামান্য অর্থাৎ ১.৩ গুণ বেশি। অবশ্য পৃথিবীর তিন গুণ ভারি হওয়াও বিচিত্র নয়।

প্রক্সিমা বি কেন্দ্রের তারকার খুব কাছে অবস্থান করছে। আমাদের সূর্যের ক্ষেত্রে এত কাছে কোনো গ্রহ যদি থাকত, তা সূর্যের তাপে পুড়ে ঝামা হয়ে যেত। তবে সূর্যের অত কাছে কোনো গ্রহ থাকা এমনিই সম্ভব নয়, তা সূর্যের টানে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। ঠিক যে কারণে গ্রহরাজ বৃহস্পতির আকর্ষণের জন্য গ্রহাণুপুঞ্জের সদস্যরা সবাই মিলে গ্রহ তৈরি করতে পারেনি। প্রক্সিমা সেন্টরির ভর কম, তাই তার আকর্ষণ বলও কম। তাই নতুন আবিষ্কৃত গ্রহটা তার এত কাছে থাকতে পেরেছে, টুকরো হয়ে যায়নি।
প্রক্সিমা সেন্টরি লাল বামন নক্ষত্র, আগেই দেখেছি যে তার থেকে যে শক্তি বেরোয় তা আমাদের সূর্যের দুই শতাংশেরও কম। তাই প্রক্সিমা বি-র তাপমাত্রা অনেক কম হওয়া উচিত। নক্ষত্রের খুব কাছের গ্রহে তাপমাত্রা এত বেশি হয় যে জল বাষ্প হয়ে যায়। আবার গ্রহ অনেক দূরে থাকলে জল ঠাণ্ডায় জমে বরফ হয়ে যাবে। মাঝের যে অংশটায় জল তরল অবস্থায় থাকা সম্ভব, তাকে বলে নক্ষত্রজগতের বাসযোগ্য অঞ্চল (Habitable zone)। আমাদের সৌরজগতের বাসযোগ্য অঞ্চল কতটা তা নিয়ে মতভেদ আছে, তবে পৃথিবী যে তার মধ্যে পড়বে, তা আমরা বুঝতেই পারছি। প্রক্সিমা সেন্টরির থেকে যে পরিমাণ শক্তি বেরোয়, তার থেকে দেখা যায় যে প্রক্সিমা বি গ্রহটাও বাসযোগ্য অঞ্চলের মধ্যে পড়বে, অর্থাৎ সেখানে জল তরল অবস্থায় থাকতে পারবে। বিজ্ঞানীরা তাই সেখানে প্রাণের সম্ভাবনা নিয়ে কিছুটা আশাবাদী।

তবে বাসযোগ্য অঞ্চলে থাকলেই সেখানে জল থাকবে এমন কোনো কথা নেই। অনেক হিসাবেই শুক্র বা মঙ্গলকেও সৌরজগতের বাসযোগ্য অঞ্চলের মধ্যে ধরা হয়েছে। মঙ্গলে তরল জল এক সময় ছিল কিনা তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো একমত নন। কিন্তু এখন যে নেই তা আমরা সবাই জানি। শুক্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৪৬০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। সেখানে জল তরল অবস্থায় থাকার প্রশ্নই ওঠে না। এমনকি আমাদের ঘরের কাছে চাঁদেও জল তরল অবস্থায় থাকতে পারে না। চাঁদ বা মঙ্গলের ক্ষেত্রে বায়ুর চাপ কম বলে জল তরল অবস্থায় পাওয়া যায় না, কম চাপে তা ফুটে বাষ্প হয়ে যাবে। এই দুই জায়গায় একমাত্র বরফ অবস্থায় জল পাওয়া যেতে পারে। শুক্রের বায়ুমণ্ডল মূলত কার্বন ডাই অক্সাইড দিয়ে তৈরি এবং ভীষণ পুরু। সেখানে গ্রিনহাউস এফেক্টের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডল তাপ ধরে রাখে। তাই শুক্রের তাপমাত্রা এত বেশি যে জল তরল বা কঠিন কোনো ভাবেই থাকতে পারে না।
যে গ্রহের ভর যত কম, তার বায়ুমণ্ডলকে আকর্ষণ বলের মাধ্যমে ধরে রাখার ক্ষমতা তত কম। তাই মঙ্গলের বায়ুচাপ খুব কম, চাঁদে তো বায়ুমণ্ডলই নেই। প্রক্সিমা বি-র যা ভর, তাতে মনে হয় সেখানে হয়তো বায়ুর চাপ কম হবে না তাই মঙ্গল বা চাঁদের মতো অবস্থা হয়তো সেখানে হবে না। (তবে বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে শেষ কথা এখনো বলতে পারছেন না, সে কথায় পরে আসছি।) শুক্রে গ্রিনহাউস এফেক্ট কেন এত বেশি তা নিয়ে এখনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো যায়নি। তাই আমরা বলতে পারব না শুক্রের মতো পরিস্থিতি প্রক্সিমা বি-তে আছে কিনা, তার জন্য গ্রহটার বায়ুমণ্ডল কী দিয়ে তৈরি তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বহির্গ্রহের বায়ুমণ্ডলের উপাদান কেমন করে জানা যায়? প্রত্যেক মৌল এবং যৌগ বিভিন্ন নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের আলো শোষণ করে। যদি গ্রহটা তারকা আর আমাদের মাঝের সরলরেখাটাকে ছেদ করে, তাহলে তারকার থেকে আমাদের কাছে যে আলো আসছে তা ঐ গ্রহের বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে আসবে। সেই সময় বায়ুমণ্ডলে যে গ্যাস থাকে সে কিছু কিছু কম্পাঙ্কের আলো শোষণ করে, সুতরাং সেই কম্পাঙ্কের আলো আমাদের কাছে কম আসবে। তাই তারকার আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করে আমরা তখন বলতে পারব বায়ুমণ্ডলে কী কী গ্যাস কত পরিমাণে আছে। আমরা এখনো জানি না প্রক্সিমা বি ঠিক ঐ সরলরেখাটাকে ছেদ করবে কিনা।
তবে প্রক্সিমা বি-তে প্রাণ সৃষ্টির পথে অন্য সমস্যা আছে। প্রথমত অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে লাল বামন নক্ষত্রেরা সব সময় একই রকম ভাবে আলো দেয় না। আমাদের সূর্যে যেমন সৌর কলঙ্ক আছে, ঠিক তেমনি লাল বামন তারকাতেও কলঙ্ক আছে। কিন্তু এই ধরণের তারকাতে কখনো কখনো কলঙ্কের পরিমাণ এত বেশি হয় যে তারকার প্রায় অর্ধেকটা ঢেকে যায়। সে সময় তাহলে গ্রহের তাপমাত্রা খুব কমে যাবে। অন্যদিকে আমরা জানি অন্য অনেক লাল বামনের মতো প্রক্সিমা বি পরিবর্তনশীল (variable) নক্ষত্র, তার ঔজ্জ্বল্য কখনো কখনো খুব বেড়ে যায়। তার ফলে গ্রহের তাপমাত্রা হঠাৎ খুব বেড়ে যেতে পারে। তাপমাত্রার এই রকম বাড়াকমা প্রাণ সৃষ্টির অনুকূল নয়। আরও একটা সমস্যা আছে। প্রক্সিমার ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধির কারণ নাক্ষত্র প্রজ্বাল (flare)। প্রক্সিমা সেন্টরির প্রজ্বালের মাত্রা এখন মাঝারি মাপের হলেও জন্মের সময় তা ছিল আরও অনেক বেশি। অনেক সময়ই প্রজ্বালের সঙ্গে বিশাল সংখ্যায় ইলেকট্রন, প্রোটন ইত্যাদি বেরিয়ে আসে। কোনো গ্রহ যদি কেন্দ্রীয় নক্ষত্রের খুব কাছে থাকে, এই কণাগুলো তার বায়ুমণ্ডলে গিয়ে ধাক্কা মারবে এবং তাকে ঠেলে মহাকাশে পাঠিয়ে দেবে। প্রক্সিমা বি-র ক্ষেত্রে এই রকম হয়ে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে হয়তো তার আদৌ বায়ুমণ্ডলই নেই।

একমাত্র গ্রহটার চৌম্বক ক্ষেত্র শক্তিশালী হলে তা ইলেকট্রন প্রোটনের মতো আধানিত (charged) কণাদের অন্য পথে নিয়ে যেতে পারে। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র এই কাজটাই করে। তাহলে গ্রহটার বায়ুমণ্ডল টিকেও যেতে পারে। কিন্তু প্রক্সিমা বি-র চৌম্বক ক্ষেত্র খুব শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা কম। গ্রহের চৌম্বক ক্ষেত্র থাকে কেন? পৃথিবীর কেন্দ্রটা মূলত গলিত লোহা ও নিকেল দিয়ে তৈরি। সেই কেন্দ্র দিনে একবার আবর্তন করে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। তারকা ও গ্রহ যদি খুব কাছে থাকে, তাহলে গ্রহ একটা পাশই তারকার দিকে ফিরিয়ে রাখবে, ঠিক যেমন চাঁদের একটা মুখই সবসময় পৃথিবীর দিকে ফেরানো থাকে। প্রক্সিমার খুব কাছে গ্রহটা থাকার ফলে তার কেন্দ্রে গলিত পাথরে যে জোয়ার ভাঁটা হয়, তা নিশ্চয় খুব শক্তিশালী। আগেই বলেছি আমাদের সূর্যের ক্ষেত্রে সেটা এতই শক্তিশালী হত যে গ্রহটা টুকরো টুকরো হয়ে যেত। প্রক্সিমা বি-র ক্ষেত্রে তা হবে না, কিন্তু গলিত পাথরের সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে গ্রহের আবর্তন বেগ কমে গেছে। তার ফলে গ্রহটা নক্ষত্রের চারদিকে আবর্তন করতে যতটা সময় নেয়, নিজের চারপাশে একবার ঘুরতেও একই সময় নিচ্ছে। এ রকম ক্ষেত্রে গ্রহের কেন্দ্রের গলিত লোহার পক্ষেও নাক্ষত্র প্রজ্বাল থেকে বাঁচানোর মতো খুব শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করা শক্ত। তাই প্রক্সিমা বি-র বায়ুমণ্ডল আদৌ আছে কিনা সন্দেহ। তার উপর গ্রহটার এক দিক সব সময় কেন্দ্রের তারকার দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে আর অন্য দিকটা সব সময় অন্ধকারে থাকে। তার মানে এক দিকে প্রচণ্ড গরম, অন্য দিকে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। এই পরিস্থিতিও প্রাণ সৃষ্টির পক্ষে খুব অনুকূল নয়।

তবে অন্য ধরণের পরিস্থিতিও সম্ভব যেখানে গ্রহে বায়ুমণ্ডল ও জল দুইই থাকতে পারে। তার জন্য গ্রহটার ভর, কক্ষপথ ইত্যাদি আরও অনেক নির্ভুলভাবে জানা প্রয়োজন। একদিকে সবসময় দিন, অন্যদিকে সবসময় রাত হলেও তাপমাত্রা খুব চরম নাও হতে পারে, কারণ বায়ুস্রোত ও সমুদ্রস্রোত হয়তো উষ্ণ থেকে শীতল অঞ্চলে তাপ বয়ে নিয়ে যেতে পারে।

অন্য এক কারণে প্রক্সিমা বি-তে জল থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমাদের জানা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রায় নিরানব্বই শতাংশ দুটি মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরি — হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। অথচ আমাদের পৃথিবীর মতো পাথুরে গ্রহে এই দুটি মৌলিক পদার্থের পরিমাণ এক শতাংশেরও কম। বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুনের মতো গ্যাস দানব গ্রহগুলো মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে তৈরি। আসলে সূর্যের জন্মের সময় তার কাছে তাপমাত্রা ছিল অনেক বেশি। তাই শুধুমাত্র লোহা, নিকেল, সিলিকন, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি ধাতু (মূলত অক্সাইড যৌগ রূপে) কঠিন অবস্থায় ছিল। জল, হাইড্রোজেন, হিলিয়াম সহ অধিকাংশ পদার্থই গ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। গ্যাসের উপর উচ্চ তাপমাত্রা এবং সৌর ঝড় (solar wind)-এর প্রভাব এত বেশি যে মাধ্যাকর্ষণ বল গ্যাস অণুদের এক জায়গায় আনতে পারেনি। কঠিন পদার্থদের এই সমস্যা নেই, তাই পারষ্পরিক মাধ্যাকর্ষণের টানে কঠিন পদার্থরা সবাই মিলে গ্রহ সৃষ্টি করতে পারে। সে কারণে একমাত্র কঠিন পাথুরে গ্রহই তারকার কাছাকাছি তৈরি হওয়া সম্ভব। নক্ষত্রের থেকে দূরে তাপমাত্রা ও সৌর ঝড়ের প্রভাব কম, সেখানে গ্যাস অণুরা নিজেদের মধ্যে মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে এক জায়গায় এসে গ্রহ সৃষ্টি করে। হাইড্রোজেন হিলিয়ামের পরিমাণ অনেক বেশি, তাই এই গ্রহরা অনেক বড়ো, এদেরই আমরা গ্যাস দানব বলি। পৃথিবী সৃষ্টির সময় তার মধ্যে জল ছিল না। সৌরজগতের বাইরের দিকে অনেক ধূমকেতু আছে, যারা মূলত বরফ ও পাথর দিয়ে তৈরি। সৌরজগত সৃষ্টির প্রথম যুগে তাদের অনেকে এসে ভেতরের গ্রহগুলোতে আছড়ে পড়েছিল। তারাই জল বয়ে এনেছিল পৃথিবীতে।

এই ছবি ঠিক হলে গ্যাস দানব গ্রহরা কখনোই কেন্দ্রীয় নক্ষত্রের কাছে তৈরি হতে পারে না। অথচ আমাদের আবিষ্কৃত অধিকাংশ বহির্গ্রহই গ্যাস দানব এবং তারা কেন্দ্রীয় নক্ষত্রের খুব কাছে আছে। তার কারণ অবশ্যই এই ধরণের গ্রহগুলোকে আমরা সহজে খুঁজে পাই, কম ভরের গ্রহদের সন্ধান মেলা শক্ত। কিন্তু নক্ষত্রের এত কাছে গ্যাস দানবরা এল কোথা থেকে? বিজ্ঞানীরা মনে করছেন সম্ভবত কোনো কারণে গ্রহেরা অনেক সময় তাদের কক্ষপথ পরিবর্তন করে, যদিও সেটা কী তা নিয়ে আমরা নিশ্চিত নই। তাঁরা মনে করছেন যে গ্যাস দানবরা সবসময়েই দূরেই তৈরি হয়, কিন্তু পরে সেগুলো হয়তো কখনো কখনো কেন্দ্রীয় নক্ষত্রের কাছাকাছি চলে আসে। এমন যদি প্রক্সিমা বি-র ক্ষেত্রে হয়ে থাকে? জন্মের সময় সে হয়তো নক্ষত্র থেকে দূরে ছিল, তাই বায়ু এবং জলকে সে ধরে রাখতে পেরেছিল। পরে সে কোনো ভাবে নক্ষত্রটার কাছে সরে এসেছে। এমন হলে সেখানে প্রাণের অনুকূল পরিস্থিতি থাকা সম্ভব।

প্রক্সিমা বি-র ক্ষেত্রে এই কল্পনাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। আমাদের তত্ত্ব অনুসারে লাল বামন নক্ষত্রের খুব কাছে প্রক্সিমা বি-র মতো বড়ো গ্রহ তৈরি হওয়া শক্ত, কারণ নক্ষত্রের অত কাছে গ্রহ সৃষ্টির মতো উপাদান খুব কম থাকার কথা। তাই বিজ্ঞানীরা মনে করছেন হয়তো গ্রহটা আরও অনেক দূরে তৈরি হয়েছিল। তবে লাল বামন নক্ষত্রের ক্ষেত্রে একটা সুবিধা আছে। আমাদের সূর্য পাঁচশো কোটি বছর আগে জন্ম নিয়েছিল, আরও মোটামুটি পাঁচশো কোটি বছর সে এইভাবেই আলো দেবে। তারপর সে মৃত্যূর দিকে এগিয়ে যাবে। প্রক্সিমা সেন্টরাই কিন্তু বাঁচবে আরও অনেক বেশি – দশ লক্ষ কোটি বছর! তাই সেখানে কোনো ভাবে প্রাণ সৃষ্টি হলে তা বহু গুণ সময় টিকে থাকার সুযোগ পাবে। আমাদের কাছের তারকাদের মধ্যে লাল বামন নক্ষত্রের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি – প্রায় সত্তর শতাংশ তারকাই লাল বামন। ( গোটা ছায়াপথের হিসাব আমরা জানি না কারণ লাল বামন তারকারা অনুজ্জ্বল বলে আমাদের থেকে দূরের লাল বামনদের আমরা খুঁজে পাই না।) তাই প্রক্সিমা বি আবিষ্কার এক ধাক্কায় আমাদের প্রতিবেশী গ্রহের সম্ভাব্য সংখ্যাকে অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে।

প্রক্সিমা বি-তে জল আছে কি নেই, সে বিষয়ে এত রকমের সন্দেহের অবসান এত দূর থেকে হওয়া কি সম্ভব? বায়ুমণ্ডল কী দিয়ে তৈরি জানলে অবশ্য কিছুটা আলো দেখা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে ভালো হবে যদি আমরা সেখানে কোনো মহাকাশযান (অবশ্যই রোবট, মানুষ পাঠানো এখনো শুধুই কল্পনা) পাঠাতে পারি যে আমাদের সেখান থেকে খবর দিতে পারবে। আমরা যে রকেট ব্যবহার করি, তা দিয়ে হবে না — আমাদের সবচেয়ে দ্রুতগামী রকেটও বহু হাজার বছর সময় নেবে। কিন্তু আরো কিছু নতুন প্রযুক্তির কথা উঠে আসছে যার সাহায্যে খুব ছোটো একটা যান হয়তো পঁচিশ থেকে তিরিশ বছর যাত্রা করে প্রক্সিমার কাছাকাছি পৌঁছোতে পারবে। এই নতুন প্রযুক্তিগুলো শুধুমাত্র মহাকাশ যাত্রা নয়, আমাদের পৃথিবীতে সাধারণ মানুষের কাজে লাগতে পারে। সে নিয়ে আলোচনার সময় আজ আর নেই। তবে যদি এরকম কোনো অভিযান সত্যিই পাঠানো যায়, তা আমাদের সৌরজগত কেমন ভাবে তৈরি হয়েছিল, পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টি হল কেমন করে, এরকম নানা সমস্যা সমাধানে সাহায্য করবে সন্দেহ নেই।