বিজ্ঞান গবেষণা’র সাথে আমি অনেকদিন যুক্ত আছি | অনেকেই এজন্য আমাকে বৈজ্ঞানিক বলে | সে ঠিক আছে | আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমি বইয়ের পাতায় বৈজ্ঞানিকদের ছবি দেখতাম | বলা হতো, ওরে বাবা, ওনারা বৈজ্ঞানিক, ওনারা তো দেবতুল্য … ওনারা সাধারণ মানুষ নন … ওনারা আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে … ওনারা আমাদের ভাষায় কথা বলেন না … ওনাদের বিরক্ত করা উচিত না, ইত্যাদি |
এখন আবার উল্টোটা শুনি| যে, আপনি বৈজ্ঞানিক | আপনারই তো দায়িত্ব সমাজের প্রতিটা মানুষকে আপনি কী গবেষণা করেন তা বোঝানো | আপনার গবেষণা কীভাবে মানুষকে সাহায্য করছে বা করতে পারে আপনি কেন সবাইকে তা বোঝাবেন না ? বৈজ্ঞানিকরা কেন সাধারণ মানুষের থেকে নিজেদের আলাদা রাখবেন?
ঠিকই তো| আজ তো আর রাজা–রাজরা নেই | আগেকার দিনে তারাই তো বৈজ্ঞানিকদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতেন | এখন বৈজ্ঞানিকরা সাধারণ মানুষের পয়সায় নিজেদের সংসার চালায় এবং নিজেদের গবেষণার খরচটুকু জোগাড় করে | সুতরাং, বিজ্ঞান সম্বন্ধে সাধারণ মানুষকে বোঝানো বৈজ্ঞানিকদেরই দায়িত্ব | এবং বোঝাতে হবে সাধারণ মানুষের ভাষায়, বৈজ্ঞানিকদের নিজেদের পরিভাষায় নয়|
বিজ্ঞান আমাদের সংস্কৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান | সুতরাং এটি সম্পর্কে জ্ঞান মানুষের প্রাপ্য। দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞান সকলের জীবনকে প্রভাবিত করে, ফলে মানুষকে এটি সম্পর্কে জানতেই হয়। তৃতীয়ত, অনেক জনমুখী প্রকল্পের সিদ্ধান্ত বিজ্ঞান-এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং যদি সেগুলি বিজ্ঞান-সচেতন জনসাধারণের বিতর্ক থেকে তৈরি হয় তবেই তারা প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রকল্প বা নীতি হয়ে উঠতে পারে| চতুর্থত, বিজ্ঞান সার্বজনীনভাবে সমর্থিত, এবং সাধারণ মানুষের থেকে সমর্থন আশা করার জন্য তাদের বিজ্ঞান-সচেতন করে তোলা বৈজ্ঞানিকদেরই দায়িত্ব।
সমাজকে বিজ্ঞান-মনস্ক এবং বিজ্ঞান-সচেতন করে তোলার দায়িত্ব যদি বৈজ্ঞানিকরা এড়িয়ে চলেন তাহলে তাঁরা নিজেরাই হেরে যাবেন | জনসাধারণের বিজ্ঞান-সচেতনতা এবং বিজ্ঞান-অজ্ঞতা’র মধ্যে তফাৎ কী? আইজ্যাক অ্যাসিমভ বলেছেন “তফাৎটা হলো- একদিকে সন্মান এবং প্রশংসা এবং অন্যদিকে ঘৃণা এবং ভয় |” বিজ্ঞানীরা যদি ধরে নেন যে তাঁরা কী করেন সেটা না বুঝেও জনসাধারণ দিনের পর দিন, বছরের পর বছর তাঁদের সমর্থন করে যাবেন, তাহলে সেটা হবে বৈজ্ঞানিকদের মূর্খামির পরিচয় |
জনগণ যদি বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, ফলাফল এবং পদ্ধতি বুঝতে পারতো তাহলে কি আমাদের সমাজ আরো উন্নত হতো ? আমি মনে করি, অবশ্যই | সার্বজনীন বিজ্ঞান-সচেতনতা বাড়লে জাতীয় সমৃদ্ধি অবশ্যই বাড়ে | সমাজের প্রতিটি মানুষ সমৃদ্ধ হয় | প্রতিটি মানুষের মন প্রশস্ত হয়ে ওঠে | কূপমণ্ডূকতা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারে | ভালো-মন্দের বিচারক্ষমতা বাড়ে | সার্বজনীন বিজ্ঞান-সচেতনতা এবং বিজ্ঞান-মনস্কতা বাড়ানো এক অর্থে ভবিষ্যতের সম্পদবৃদ্ধি করা, এই কাজে সময় নিয়োগ করা মোটেই বিলাসিতা নয় |
সরকার এবং সিভিল সার্ভিস অফিসাররা বিজ্ঞান আরও ভালোভাবে বুঝলে জাতীয় বিজ্ঞাননীতি আরো ভালোভাবে প্রণয়ন করা যায়| মৌলিক, কৌশলগত এবং প্রয়োগযোগ্য গবেষণার মধ্যে যে আন্তঃসম্পর্ক সেগুলি সরকারের বোঝা দরকার | এই তিনটি পর্যায়ের অনিশ্চয়তা ও আপেক্ষিক সময়সীমা এবং খরচ, এগুলিও সরকারের বোঝা উচিত- অবশ্যই বিজ্ঞানীদের সাথে আলোচনা করে | মৌলিক গবেষণার মান উন্নত না হ’লে, প্রায়োগিক গবেষণা ভালো হতে পারে না | এজন্য উচ্চশিক্ষা খাতে ব্যয়ের বরাদ্দ বাড়াতে হবে |
সবশেষে এটাই বলতে চাই, বিজ্ঞানীদের সময় নিয়োগ করতে হবে সাধারণ মানুষ এবং সরকার- উভয়কেই বিজ্ঞানের ধারা এবং উপকারিতা বোঝানোর জন্য| এটা সময়ের অপব্যয় নয়, নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য আমাদের দায়িত্বশীল অবদান|