প্লেট-টেকটোনিক, শব্দটা শুনলেই মারাত্মক ভূমিকম্প বা সুনামির কথাই মাথায় আসে । বৃহস্পতির উপগ্রহ ইওরোপা-র বরফের আস্তরণেও পৃথিবীর মতোই প্লেট-টেকটোনিক নড়াচড়া ঘটতে পারে । ব্রাউন ইউনিভার্সিটির নতুন এক গবেষণায় উঠে আসা এই তথ্যই হয়তো ইওরোপার তুষারস্তব্ধ জমির নীচে, সমুদ্রে থাকা প্রাণের সন্ধানে পথ দেখাবে বিজ্ঞানীদের ।
‘জার্নাল অফ জিওগ্রাফিকাল রিসার্চঃ প্ল্যানেটস’ পত্রিকায় গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে । কম্পিউটার মডেলে দেখা গেছে, একটি টেক্টোনিক প্লেট অন্য একটি প্লেটের নীচে প্রবেশ করে, এবং গ্রহের কেন্দ্রকের দিকে ক্রমাগত ডুবতে থাকে । ইওরোপার উপরিতলের বরফেও অনুরূপ ঘটনা ঘটতে পারে ব’লেই গবেষকদের দাবী । পৃথিবীর সমুদ্রমধ্যে যেমন সম্প্রসারণশীল শৈলশিরা, এই উপগ্রহের বরফের স্তরে তেমনই চলন আছে ব’লে ধারণা হয়েছিল আগের কিছু গবেষণায় । ব্রাউন ইউনিভার্সিটির নতুন অনুসন্ধানটি পূর্বতন ধারণাগুলিকেই পোক্ত করলো ।
অধ্যাপক ব্র্যান্ডন জনসন এই প্রসারণ ও চলনের প্রমাণ পাওয়ার পর একধাপ এগিয়ে প্রশ্ন রেখেছেন, “ তাহলে উপরিতলে থাকা পদার্থগুলি যাচ্ছে কোথায় ?” তাঁর কথায়, পৃথিবীতে যেমন সাবডাকশন জোন আছে, সেই অনুযায়ী আন্দাজ করলে হয়তো ইওরোপার অন্দরেও চলছে একইধরণের সাবডাকশন” ।
জনসন আরও যোগ করছেন, উপরিতলে গঠনগত উপাদান হিসেবে জারক পদার্থ এবং জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য রাসায়নিক রসদ থাকে । সেই রসদই সাবডাকশনের দরুন ইওরোপার বরফস্তরের নীচে থাকা সমুদ্রের সংস্পর্শে আসে । অর্থাৎ, প্রাণের বিকাশ ঘটার প্রাক্বালে সাবডাকশনের কৃপাতেই জীবনের রসদ পায় প্রাণ ।
নিমজ্জিত প্লেট আর পারিপার্শ্বিক ম্যান্টেল-এর উষ্ণতার তারতম্যের জন্য সাবডাকশন ঘটে পৃথিবীর বুকে । ক্রাস্টের পদার্থের শীতলতা ও ঘনত্ব ম্যান্টেল পদার্থের চেয়ে বেশী । এই বর্ধিত ঘনত্বের দরুন সৃষ্ট ঋণাত্মক প্লবতা প্লেট বা স্ল্যাবটিকে ম্যান্টেলের গভীরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে ।
ইওরোপার উপরিতলে যে সাবডাকশন হতে পারে, তার আভাস পাওয়া গিয়েছিল পূর্ববর্তী অনেক গবেষণাতেই, তবে কোন পদ্ধতিতে ঘটনাটি ঘটত সেই নিয়ে ধন্দ ছিলই । জনসনের মতে, ইওরোপার উপরিতলের বরফে দুটি স্তর- উপরে অত্যন্ত ঠাণ্ডা বরফের পাতলা স্তর আর নীচে কিঞ্চিৎ উষ্ণতর বরফের জমাট স্তর । বহিস্তরের থেকে কোন প্লেট যখনই উষ্ণতর স্তরটিতে নেমে আসে, দ্রুত গরম হতে থাকে উপরের স্তরটি । কিছু সময়ের পর, দুটি স্ল্যাবের ঘনত্ব সমান হলে, প্লেটের চলন বন্ধ হয় ।
তবে ব্রাউন ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার মডেলিং অনুযায়ী উষ্ণতার হেরফের ব্যাতিরেকেই ইওরোপার বুকে সাবডাকশন সম্ভব । মডেলে দেখা যাচ্ছে, বরফস্তরের উপর বিভিন্ন পরিমাণে লবণের উপস্থিতি দুটি স্ল্যাবের মধ্যে ঘনত্বের তারতম্য রক্ষা করে । ফলে, প্লেট নিমজ্জন সম্ভবপর হয় ।
পৃথিবীর ম্যান্টেল থেকে যেমন ম্যাগমা নির্গত হয়, ইওরোপার উপরিতলে তেমনই কালেভদ্রে সিঞ্চিত জল উঠে আসে । ভূগর্ভস্থ জলের এই প্রস্রবণের দরুন ইওরোপার ক্রাস্টে ব্যাপক পরিমাণে লবণের খোঁজ আগেই পেয়েছে বিজ্ঞানীরা ।
সৌরজগতের মধ্যে আমাদের পৃথিবী ছাড়াও যে কোন গ্রহ বা উপগ্রহে প্রাণের উপযোগী সমুদ্র থাকতে পারে, গবেষক জনসনকে উৎসাহিত করে তুলেছে এটাই । আমাদের গ্রহের বিবর্তনের রহস্যেরও কিছুটা হদিস পাওয়া যাবে এই গবেষণার পরে ।