মানব জাতির মধ্যে সাধারনত নীল চোখের মানুষদের সংখ্যা বাদামী চোখের মানুষদের থেকে কম। এইজন্যই বোধহয় নীল রঙের কন্ট্যাক্ট লেন্স এত বেশি জনপ্রিয়।
নীল চোখ সম্পর্কে আমরা কিছু তথ্য জেনে নেবোঃ
১।নীলবর্ণ চোখের মানুষের পূর্বপুরুষ হয়ত একজনই
প্রায় ছয় থেকে দশহাজার বছর আগে ইউরোপে কোনো এক প্রাচীন মানবের জেনেটিক মিউটেশনের পর থেকেই নীল রঙের চোখের উৎপত্তি হয়েছে, এমনটাই বলছেন কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। “আসলে আমাদের সকলের চোখের রঙ বাদামীই ছিল” বলছেন হ্যন্স ইবার্গ, ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই সেলুলার অ্যান্ড মলিকিউলার মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক যিনি এই বিষয়ের গবেষণার নেতৃত্বে রয়েছেন, “কিন্তু জেনেটিক মিউটেশনের ফলে আমাদের ক্রোমোজোমের OCA2 জিন প্রভাবিত হয় যার ফলশ্রুতি একধরনের ‘সুইচ’ সৃষ্টি হয়েছে, যা আক্ষরিক অর্থেই বাদামী বর্ণের চোখ তৈরির ক্ষমতাকে বন্ধ করে দিয়েছে” ইবার্গ আরো বলেন।
চোখের মণির বর্ণ নির্ধারিত হয় করে চোখের মণিতে অবস্থিত একধরনের রঞ্জক পদার্থ(মেলানিন)দ্বারা। OCA2 জিনের ঠিক পরে অবস্থিত এই ‘জেনেটিক সুইচটি’ মেলানিন উৎপাদনে রাশ টেনে বাদামি চোখকে ক্রমশ নীল বর্ণে পরিণত করতে পারে।
বাদামী বা সবুজ চোখের মানুষের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কম পরিমাণ মেলানিন থাকে নীল চোখের মানুষদের। এছাড়া নীল বর্ণের চোখের মানুষদের মধ্যে জিনে বা জেনেটিক কোডে খুব অল্প পরিমাণ ভ্যারিয়েশন বা পার্থক্য দেখা যায় যা মেলালিন উৎপাদনে দায়ী। আবার বাদামী চোখের মানুষদের DNA এর যে অংশ দ্বারা মেলানিন উৎপাদন নিয়ন্ত্রিত হয় তা রীতিমত বেশি এবং গূরুত্বপূর্ণ।
“এর থেকে আমরা বলতে পারি সমস্ত নীল বর্ণের চোখের মানুষজন কোনো একজন পূর্বসূরীর থেকে উদ্ভুত”- ইবার্গ বলেন, “এরা সবাই DNA এর একই স্থানে একই ‘জেনেটিক’ সুইচ লাভ করেছেন”।
এখন যদি কোনো একক ব্যক্তিত্বের জেনেটিক মিউটেশনের ফলশ্রুতি এইটি ঘটে থাকে তাহলে ইউরোপের দেশগুলোর ২০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য ছড়িয়ে পড়ল কিভাবে?
একটি মতবাদ অনুযায়ী, নীল বর্ণ চোখ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠায় অনেকেই এই বৈশিষ্ট্যের মানুষের সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হতে চায় (সন্তান জন্ম দেওয়ার উদ্দেশ্যে), আর তার ফলেই এই মিউটেশন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে।
২। নীল রঞ্জক পদার্থ ছাড়াই নীল বর্ণের চোখ সৃষ্টি হয়
আগেই আমরা জেনেছি যে চোখের এই নীল বর্ণ মেলানিন নামক রঞ্জক নির্ধারণ করে। এটি একটি বাদামী রঞ্জক পদার্থ1 যা আমাদের চোখ, ত্বক এবং চুলের রঙ নিয়ন্ত্রন করে।
আমাদের চোখের রঙ নির্ভর করে মণিতে মেলানিনের পরিমাণের ওপর। মজার ব্যাপার হল একমাত্র বাদামী রঞ্জকই নীল বা সবুজ সমস্ত রংগুলোর জন্য দায়ী। আলাদা করে নীল বা সবুজের জন্য কোনো রঞ্জক নেই। বাদামী চোখের ক্ষেত্রে মেলানিনের পরিমাণ সর্বাধিক এবং নীল বর্ণের চোখে সবচেয়ে কম।
৩। সন্তানের চোখের রঙ অনুমান করা সম্ভব নয় আদৌ
একসময় মনে করা হত চোখের রং, এমনকি নীল রঙের এই বৈশিষ্ট্যও আসলে সাধারণ জেনেটিক কোনো বৈশিষ্ট্য। পিতা মাতার চোখের রঙ জানা থাকলে সন্তান বা পিতামহ-পিতামহীর চোখের রঙ অনুমান করা সম্ভব।
কিন্তু আধুনিককালে জেনেটিসিস্টরা জেনেছেন যে চোখের রঙ প্রায় ১৬টি আলাদা আলাদা জিন দ্বারা প্রভাবিত হয়- আগের ধারণা অনুযায়ী একটা বা দু’টো জিন দ্বারা নয়।
আর তাই সন্তানের চোখের রঙ অনুমান করা অসম্ভব। এমনকি যদি আপনি এবং আপনার সঙ্গীর চোখের রং নীল হয় তাহলেও আপনাদের সন্তানের চোখের রঙ নীলই হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।
(চোখের রঙ সম্পর্কিত রাজপরিবারের একটি উদাহরণঃ রাজকুমারী শার্লোর চোখের রং নীল, যিনি নীল চোখের অধিকারী রাজপুত্র উইলিয়াম এবং সবুজ চোখের অধিকারিণী তার স্ত্রী কেট মিড্লটনের কন্যা। আবার তার ভাই রাজকুমার জর্জের চোখের রঙ বেশ বাদামী।)
৪। জন্মকালে চোখের রঙ নীল হলেই সারাজীবন তা বজায় থাকবে এমন কোনো মানে নেই
জন্মের সময় মানুষের চোখে প্রাপ্তবয়ষ্কদের সমপরিমাণ রঞ্জক উপস্থিত থাকে না। তাই অনেক সময় শিশুর চোখের রঙ জন্মের সময় নীল হলেও পরে তা মেলানিন উৎপাদনের পরিমাণ অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়ে যায়, তাই একদম ঘাবড়ে যাবেন না যদি আপনার সন্তানের “বেবি ব্লু” বা জন্মকালের নীল চোখ বয়সের সাথে ব্দলে গিয়ে সবুজ বা কিছুটা বাদামী হয়ে ওঠে।
৫। নীল চোখ সংক্রান্ত ঝুঁকি
চোখে উপস্থিত মেলানিন সূর্য এবং বিভিন্ন কৃত্রিম উৎস থেকে উৎপন্ন অতিবেগুনি রশ্মি এবং দৃশ্যমান উচ্চশক্তি সম্পন্ন ক্ষতিকর আলোর (নীল আলো) প্রভাব থেকে চোখের পশ্চাদভাগকে রক্ষা করে।
যেহেতু নীল চোখে বাদামী বা সবুজ চোখের চেয়ে কম মেলানিন থাকে তাই এইসব রশ্মির বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষায় তারা একটু হলেও কম সামর্থ। গবেষণায় দেখা গেছে নীল চোখের মানুষদের ‘এজ-রিলেটেড ম্যাকিউলার ডিজেনারেশন’(AMD) সংক্রান্ত রোগের ঝুঁকি থাকে,যা আসলে দুর্লভ এবং ভয়ঙ্কর ধরনের ক্যানসার ‘ইউভিয়াল মেলানোমা’।
এইকারণে সূর্যের আলোর থেকে নীল রঙের চোখের মানুষদের একটু সাবধান থাকাই বাঞ্ছনীয়। যেহেতু চোখ সারাজীবনের জন্য সূর্যালোকে উন্মুক্ত থাকে তাই অতিবেগুনি রশ্মি এবং ক্ষতিকর নীল আলো সারাজীবন ধরেই চোখের ক্ষতি করতে পারে। এক্ষেত্রে সানগ্লাস পড়া ছোটোবেলায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুরু করা উচিত। সানগ্লাসের মাধ্যমে ক্ষতিকর রশ্মিগুলো প্রায় একশো শতাংশ প্রতিরোধ করা যায়।
এছাড়া ফোটোক্রোমিক লেন্সের সাহায্যেও এইসব রশ্মির মোকাবিলা করা যেতে পারে। এরা ঘরে বাইরে প্রায় সব জায়গাতেই ক্ষতিকর রশ্মি সম্পূর্ণ রোধ করতে সক্ষম এবং সূর্যালোক অনুযায়ী এই লেন্স আপনা থেকে কালো হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে আলাদা করে পকেটে করে সানগ্লাস নিয়েও ঘুরতে হয় না।
অ্যান্টি-রিফ্লেকটিভ কোটিং বা প্রতিফলন-রোধকারী আস্তরণ ফোটোক্রোমিক লেন্সে লাগিয়ে নিলে দেখার পক্ষে তা যেমন ভালো আবার আরামদায়কও (গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রেও)। সিঙ্গল ভিশন, বাইফোকাল এবং প্রোগ্রেসিভ লেন্সের ক্ষেত্রেও এই আস্তরণ লাগিয়ে নেওয়া যেতে পারে স্পষ্ট, প্রতিফলনমুক্ত ও আরামদায়ক দৃষ্টির জন্য।
আবার আপনি যদি অনেকক্ষণ কম্পিউটারের সামনে কাজ করেন তাহলেও এই ধরনের চশমা পরে নেওয়া ভালো, কারণ যন্ত্রজনিত ক্ষতিকর নীল আলোর বিরুদ্ধে এই চশমাগুলো বেশ কাজের। কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের এইসব ক্রমবর্ধমান বিকিরণের ফলে চোখের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে, এমনকি ক্ষতির পরিমাণ টের পেতে বহু বছর সময় লেগে যায়। চক্ষু বিশেষজ্ঞরা বলেন চোখের যত্নের ব্যাপারে সবসময় সতর্ক থাকাই সমীচীন- বিশেষত নীল হলে তো বটেই।
মজাদার তথ্যঃ গবেষণা বলছে নীল চোখের অধিকারীরা মদ্যপানে আসক্ত হলে অ্যালকোহলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। আমেরিকান জার্নাল অফ মেডিসিনে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে গাঢ় চোখের সদৃশ ইউরোপীয় আমেরিকান মানুষদের সাথে তুলনায় প্রায় তিরাশি শতাংশ নীল চোখের মানুষ মদ্যপানে নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারেন।