প্যারিস চুক্তি মানতে হলে, উত্তরের দেশগুলিকে বনসংরক্ষণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে কোপ২২ সম্মেলনে।
অরণ্য রক্ষার খাতিরে দক্ষিণের দেশগুলিতে জমির মালিকদের কাছে জঙ্গল বাঁচানোর থেকে জঙ্গল কেটে ফেলার খরচ বেশী রাখতে হবে উত্তরের দেশগুলিকে। যদিও, এই নীতির অন্দরেই বিরোধিতা রয়ে গেছে, এমনই দাবী ‘জার্নাল অফ ইকোনমিক থিওরি’তে প্রকাশিত নতুন একটি গবেষণার।
নিরক্ষীয় অঞ্চলে বনভূমি ধ্বংসের কারণে সামগ্রিকভাবেই পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের এই যে ভয়াল গ্রাস সভ্যতার মাথার উপরে – তার দায়ও বর্তায় দক্ষিণের দেশগুলির উপরেই। পরোক্ষভাবে উত্তরের দেশগুলিও প্রভাবিত হয়, তাই অনেকক্ষেত্রে উত্তরের রাষ্ট্রনায়করা টাকা দিয়ে গাছ কাটা বন্ধ করে থাকেন। গবেষণায় ব্যবহৃত তাত্ত্বিক রূপরেখা বলছে, দক্ষিণ একমাত্র তখনই তাদের জঙ্গল কাটা বন্ধ করতে পারে, যদি তারা নিশ্চিত হয় যে ভবিষ্যতে উত্তরের দেশগুলি তাদের অর্থনৈতিক প্রতিজ্ঞাটি পালন করে বাস্তবে। এদিকে, নীতির দ্বন্দ্ব এমনই যে, উত্তরের দেশগুলি মূলত ক্ষতিপূরণ দিয়ে থাকে, অর্থাৎ জঙ্গলের গাছ কাটা হলে বা নষ্ট হলে।
গবেষণা দলের তরফে অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোফেসর বার্দ হারস্টাদ মনে করছেন, এ এক ঘোরতর অচলাবস্থা। তাঁর মতে, নীতির ভিতরেই তৈরি হওয়া মৌলিক বৈপরীত্যই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে বনসংরক্ষণের জন্য বাজার এখনও তৈরি হয়নি। জঙ্গল কাটার সময় ন্যূনতম সংযম বজায় রেখেই কিছুটা বনভূমি ছেড়ে রাখতে হবে এবং সংরক্ষণের জন্য তহবিল বানানোর কাজ যত দ্রুত সম্ভব শুরু করতে হবে।
পৃথিবীর ৩০% অরণ্য অঞ্চল। পুড়িয়ে, কেটে বা ছোটো করতে করতে প্রতিবছর প্রায় ১২০,০০০– ১৫০,০০০বর্গকিলোমিটার জঙ্গল ধ্বংস করা হয়। সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে প্রতি সেকেন্ডে ৪৮ খানা ফুটবল মাঠ ! ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের তথ্য বলছে, ১.৬ বিলিয়ন মানুষের জীবন সরাসরি নির্ভর করে জঙ্গলের উপর।
অরন্যছেদনের ফলস্বরূপ পরোক্ষভাবে হলেও সারা পৃথিবীকেই মাশুল গুনতে হয়। আবহাওয়ার মর্মান্তিক অভিশাপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার একাংশে তীব্র জলসংকট, খাদ্যসমস্যা – সব কয়টি ক্ষেত্রেই নেপথ্যে সেই সবুজধ্বংসের পাপ। উত্তর গোলার্ধের দেশগুলির কাছে দক্ষিণে বনসংরক্ষণ করে যে পরিমাণে লাভবান হয়, দক্ষিণের দেশগুলি গাছ কেটে তা পায় না। যেমন, অনেক সময়েই উত্তরের দেশগুলি দক্ষিণের দেশগুলিতে সংরক্ষণের খাতে টাকা ঢালে- কখনও এককালীন নগদ টাকার বিনিময়ে সম্পূর্ণ বনভূমি কিনে নিয়েঅথবা সেই জমিতে লিজ নিয়ে।
বিভিন্ন দেশ অরণ্যরক্ষণে তহবিল উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। অর্থনীতির অমোঘ পরিহাসে, তাই এই সাধু উদ্যোগগুলির মধ্যেও ঢুকে পড়েছে মুনাফার রাজনীতি, নাকি বলা ভালো রাষ্ট্রনীতি !
প্রোফেসর হারস্টাদের দাবী, উত্তরের দেশগুলি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সময়মতো টাকা দেয় না। এবং দক্ষিণের রাষ্ট্রনেতাদের কাছে অবিশ্বাসের জন্য এটুকুই যথেষ্ট। ওষুধ বাতলেছেন হারস্টাদ- আন্তর্জাতিক লিখিত চুক্তির মাধ্যমে এই তহবিল প্রদানের প্রস্তাব তিনি রেখেছেন।
প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী যদিও প্রতিটি রাষ্ট্রই অরণ্য সংরক্ষনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু এই গবেষণা বলছে অন্য কথা। যুক্তিসঙ্গতই যে, যে সমস্ত দেশ তাদের বনভূমি বাঁচিয়ে রাখবেন, তাদের আর্থিক অনুদান পাওয়ার অধিকার আছে। এবং সেটাও বেশ ফলপ্রসূ দিকে হলেই ভালো হয়। তাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করার পূর্ণ অধিকার আছে।
হারস্টাদ বলছেন, এই সংরক্ষণের নিয়ম যদি কার্যকর হয়, তবে আর্থিক সাহায্যের নিশ্চিতকরণ প্রয়োজন, ভবিষ্যতের জন্য হলেও।