সর্বপ্রথম বড়োমাপের সংখ্যাগত পরীক্ষায় উৎরে গেল ডারউইনের ‘ইউনিভার্সাল কমন অ্যান্সেস্ট্রি’ তত্ত্ব

সর্বপ্রথম বড়োমাপের সংখ্যাগত পরীক্ষায় উৎরে গেল ডারউইনের ‘ইউনিভার্সাল কমন অ্যান্সেস্ট্রি’ তত্ত্ব

Posted on ৯ এপ্রিল, ২০১৯

দেড়শ বছর আগে, ইউনিভার্সাল কমন অ্যান্সেস্ট্রি তত্ত্বের অবতারণা করেন চার্লস ডারউইন। তাতে বলা হয়েছিল, এককোষী অণুজীব থেকে শুরু করে আধুনিক মানুষ অবধি সমস্ত প্রাণই একটি সাধারণ জেনেটিক ঐতিহ্যের ফসল। যদিও, এখনও পর্যন্ত লেডিবাগ, ওক গাছ, শ্যাম্পেন ইস্ট এবং মানুষের দূর সম্বন্ধীয়দের পরীক্ষাগারের গবেষণায় অন্তত ধরা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি, ব্র্যান্ডিস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক কর্তৃক ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত নতুন গবেষণাপত্রে, এই প্রথমবার বড়ো মাপের সংখ্যাভিত্তিক পরীক্ষার ফলাফল উঠে এসেছে ডারউইনের সেই বিখ্যাত তত্ত্বের সপক্ষে।

ডারউইন প্রথম থেকেই যে সঠিক ছিলেন, আরও একবার তা প্রমাণিত হল। ১৮৫৯ সালে ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস’ বইটিতে ব্রিটিশ এই প্রকৃতিবিজ্ঞানী প্রস্তাব রাখেন, সমস্ত জীব, যারা কোনও না কোনও সময়ে পৃথিবীতে জীবনধারণ করেছে, প্রত্যেকেরই উৎপত্তি আদিতম কোনও গঠন থেকেই। গত শতাব্দী থেকেই, এই তত্ত্বের পক্ষে গুণগত নানা পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে বিকশিত হয়েছে, অনেক বেশিই হয়েছে, বিবর্তনের সাক্ষ্যস্বরূপ জীবাশ্ম পাওয়া গেছে বহু, এমনকি আণবিক স্তরে জীববৈজ্ঞানিক প্রমাণও মিলেছে সেই সঙ্গে।

বিবর্তনবিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতপার্থক্য তবুও ছিল, সমস্ত প্রাণের সৃষ্টি কি একটি সাধারণ বংশবৃক্ষ থেকেই হয়েছে, নাকি এমন বহু বীজ ছড়িয়েই ছিল সারা পৃথিবীতে ? জীবনের তরঙ্গ বলা হচ্ছে সেই আন্তঃসম্পর্কিত বংশবৃক্ষগুলিকে। অধুনা কিছু আণবিক পরীক্ষায় ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, অনেকগুলি অনুভূমিক বিক্ষিপ্ত জিনবৈচিত্র্যের মিশেলের মধ্য দিয়ে মৌলিক প্রাণটিকে হাঁটতে হয়েছে, এখনও যা এককোষী জীবদেহে গতানুগতিক প্রজনন ছাড়াই ঘটে থাকে। তাই কিছু বিজ্ঞানী তর্কের জায়গাটা ছেড়ে রাখতে চান, হয়তো অনেক পূর্বপুরুষ থেকেই জাত আজকের এই জীবসম্ভার, আন্তঃক্রিয়াশীল একাধিক জীবনতরঙ্গের সাথেই।

জীবরাসায়নিক ডগলাস থিওবাল্ডের মতে, এগুলো কোনো ব্যাপারই নয় – জীবন যদি বহুবৃক্ষের সম্মিলিত ফসলই হয়, তাও সেখানে অটুট থাকে ইউনিভার্সাল কমন অ্যান্সেস্ট্রি তত্ত্বটি। হয় একটি বংশবীজ থেকেই সমস্ত প্রাণী অথবা, ভিন্ন প্রজাতিগোষ্ঠী সময়ের স্রোতের সাথেই সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে একটিমাত্র সাধারণ বীজ সংরক্ষণ করে আজকের এই জীববৈচিত্র্য। দুটি ক্ষেত্রেই, সমস্ত প্রাণই জিনগতভাবে সম্পর্কিত।

শক্তিশালী গণনার পদ্ধতি এবং বেইজিয়ান সংখ্যাতত্ত্বের প্রয়োগে, থিওবাল্ডের প্রতিটি ফলাফলই ব্যাপকভাবে ইউসিএ তত্ত্বকে সমর্থন করছে। মাল্টিপল ইন্ডিপেন্ডেন্ট অ্যান্সেস্ট্রির যেকোনো তত্ত্বের চেয়েই যে ইউসিএ বহুগুণে সম্ভাব্য, তা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথেই বলছেন এই গবেষক।

“শেষ দশকে জীববিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ উন্নতিগুলি ঘটেছে, অভূতপূর্বভাবেই তাই ডারউইনের তত্ত্বকে যাচাই করে নেওয়া সম্ভবপর আমাদের কাছে”, থিওবাল্ড বলছেন এমনই। তিনি আরও যোগ করছেন, একটি স্বতন্ত্র জীবদেহে প্রতি তিন বছর অন্তর জেনেটিক ক্রমপর্যায় দ্বিগুণ হয় এবং আমাদের গণনাপদ্ধতিও কিছু বছর আগের তুলনায় অনেক বেশী আধুনিক।
এর আগে অবধি বিজ্ঞানীরা বিশেষ গোষ্ঠীর প্রাণীদের ক্ষেত্রে এইরকমের পরীক্ষা হয়তো করেছেন, যেমন কেবলমাত্র মেরুদণ্ডী প্রাণীদের উপর। কিন্তু থিওবাল্ডের নিয়মমাফিক পরীক্ষাতেও জীবসমূহের তিনটি গোষ্ঠীকেই ( ইউক্যারিয়ট, ব্যাক্টিরিয়া এবং আর্কিয়া ) নিয়েই তিনি ডারউইনের নীতি যাচাই করেছেন।

সমস্ত জীবদেহে খোঁজ মেলে, বিশ্বজনীনরূপে সংরক্ষিত এমন ২৩টি প্রোটিনের একটি সেট থিওবাল্ড পরীক্ষা করে দেখেছেন। জীবসম্ভারের তিনটি গোষ্ঠীর প্রত্যেকটি থেকে চারটি প্রতিনিধিমূলক জীব তিনি বেছেছেন। যেমন ধরা যাক, আর্কিয়াল অণুজীবের দেহে এই প্রোটিনগুলির কিধরণের জিনগত সাদৃশ্য, যে অণুজীবগুলি হয়তো মার্শ গ্যাস বা মিথেন গ্যাস তৈরি করতে পারে মানুষ ও গরুর দেহে; অথবা ফলমাছি, মানুষ, গোলকৃমি, বেকারির ইস্টে থাকে; অথবা ই কোলাই নামক ব্যাক্টিরিয়ার শরীরে থাকে, এমনকি হয়তো মানবদেহে যক্ষ্মারোগ সৃষ্টি করে।

আধুনিক প্রোটিনগুলির বৈচিত্র্য কিভাবে তৈরি হয়, তা নিয়েই কিছু সাধারণ অনুমানের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে থিওবাল্ডের এই গবেষণা। পিতামাতার মধ্যে একজন যেমন প্রজননকালে তাদের মিলিত জিনের মধ্যে একটিমাত্রের সদৃশ জিন সমস্ত সন্তানের মধ্যে বণ্টন করে দেন, তেমনই বংশগতির ধারায় এই প্রোটিনগুলি বহুগুণ বেশী সংখ্যায় জিনগত সাদৃশ্যসম্পন্ন নতুন প্রোটিন তৈরি করে। আবার, প্রোটিনের ক্ষেত্রে আয়নের উপর প্রতিলিপিকরণ এবং অভিব্যক্তির দরুন প্রোটিনগুলিও তাদের প্রাচীন গঠন ভেঙ্গে নতুন মোড়কে উপস্থিত হয়। মূলত এই দুটি বিষয়ই প্রোটিনের আধুনিক রুপের নেপথ্যে। এছাড়াও তাঁর অনুমান, এক প্রজাতির জিনগত পরিবর্তনে অন্য প্রজাতির অভিব্যক্তিতে প্রভাব ফেলে না, যেমন- কাঙ্গারু যদি জিন পাল্টায়, তাতে মানুষের কোনো জিনের পরিবর্তন ঘটবে না।

প্রোফেসর থিওবাল্ড যেটা আন্দাজ করেন নি, জীব সভ্যতার ধাপে ধাপে এই যোগসূত্রগুলি কতদূর আমরা খুঁজে পাবো, বা খুঁজতে হবে ? মানুষের মধ্যে একে অপরের দ্বারা জিনগতভাবে এই পদ্ধতিতে যোগসূত্র পাওয়া সম্ভব এই প্রোটিনগুলির সম্বন্ধে। কিন্তু এই পদ্ধতিতে কি মানুষের সাথে অন্য প্রাণীর বা প্রাণীদের সাথে বাকি ইউক্যারিয়টদের জিনভিত্তিক সেতুনির্মাণ সম্ভব ? প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তরেই খুব দৃপ্তভাবেই বলা যায়, হ্যাঁ।

কেমন দেখতে ছিল সেই আদিপ্রাণ, কোথায়ই বা থাকত সে ? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে অবশ্যই সক্ষম নয় থিওবাল্ডের গবেষণা। যদিও থিওবাল্ড নিজে অনুমান করছেন, সমুদ্রের নীচে কোনো এক ভূতাপ ক্ষেত্রে ফেনায়িত হয়ে বেঁচেছিল সে, অণুর চরাচরে সেও এমনই জটিল এমনই সুন্দরদর্শন, মানবের মতোই।