ডারউইনের তত্ত্বে হয়তো পরিমার্জনা আনবে পাখিদের গান

ডারউইনের তত্ত্বে হয়তো পরিমার্জনা আনবে পাখিদের গান

Posted on ৯ এপ্রিল, ২০১৯

বসন্তের দুপুরে পাখির গান হয়তো মধুর মনে হয় আমাদের, যদিও ব্যাপারটা তার চেয়েও কিছুটা বেশিই গুরুত্বপূর্ণ উইলিয়ামস কলেজের জীববিদ্যার অধ্যাপক হিথার উইলিয়ামসের কাছে। প্রাকৃতিক পৃথিবীতে ঠিক কোন সুতোয় যোগাযোগের মন্ত্রটি আটকে আছে, সে নিয়ে বিস্তর কৌতূহল বিজ্ঞানীদের। পাখির গান শুধুমাত্র তথ্যসমন্বিত একগুচ্ছ আওয়াজ-শব্দ না, বরং তুষারস্তব্ধ সময়নদীতে প্রোথিত আচরণের জীবাশ্ম।

ফান্ডি উপসাগরের তীরে কেন্ট নামক ছোট্ট এক ক্যানাডিয়ান দ্বীপে সাভানা-চড়ুই গরমের মাসগুলো কাটায়। এই পাখিদের গান সংগ্রহ এবং সেগুলি বিশদে সজ্জিত করাই হিথারের একটি প্রোজেক্টের কাজ। মাইক্রোফোন, দূরবীন আর একেক প্রজাতির পাখিদের নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ ভিত্তিকে পুঁজি করে হিথারের গবেষণা সুস্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে, কীভাবে পাখির গান বন্য পরিবেশে আশেপাশে ছড়িয়ে প’ড়ে সঞ্চারিত হয় যুগে যুগে প্রতিটি প্রজন্মে। বিবর্তনের আলোচনায় ঠিক কোথায় ভাব আদানপ্রদানের বিষয়টি জায়গা করে নেয়, নতুন জ্ঞানের আলোয় হয়তো বোঝা যাবে তা’ও।

অনেক প্রাণীর ক্ষেত্রেই ধ্বনির ব্যবহারে যোগাযোগসাধনের প্রক্রিয়াটি বেশ সাধারণ। কিন্তু শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সাহায্যে ভিন্ন ইঙ্গিত সৃষ্টি করে তারা যে আদানপ্রদানের জটিলতর অর্থে ডুব দিতে চায়, মানুষ ছাড়া এ দৃষ্টান্ত বিরল। বানরপ্রজাতীয় প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র মানুষই কণ্ঠস্বর শুনে শিখতে পারে ( এছাড়াও কণ্ঠে উৎপন্ন শব্দ আয়ত্ত করতে পারে ডলফিন, তিমি, কিছু প্রজাতির বাদুড় ও কিছু সিন্ধুঘোটক প্রজাতিও )। আবার অপরদিকে, প্রায় ৫০০০টি পক্ষীপ্রজাতি তাদের গান শিখতে পারে।

Frequency graph of bird’s songs মানুষ শৈশবে যেমন ভাষা শিখতে শুরু করে, তেমনভাবেই যে পাখিরা তাদের গান আয়ত্ত করে – আগের প্রজন্মের গাইয়ে পাখির বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন এমনই তথ্য। নিবিষ্টচিত্তে তারা প্রথমদিকে গান শোনে, তারপর শিশুদের ‘ব্যাব্লিং’-এর মতোই তারা কোনও একটি গানের একটি বিশেষ অংশ রপ্ত করে। পরে তারা শারীরিক ইঙ্গিতের মাধ্যমে এবং শব্দের গভীরে গিয়ে নিজেদের স্বরযন্ত্র বিকশিত করার কাজেই নিমগ্ন হয়, এমনই লিখেছেন প্রোফেসর উইলিয়ামস। এই কৃত্রিম সঙ্গীতাংশ আয়ত্ত করার পরে তারা শুনে শেখা বিভিন্ন গানের অংশ জুড়ে নকলনবিশি রপ্ত করে। পরে যদিও স্থিতাবস্থা আসে, একটাই সুরে তারা পোক্ত হয়ে ওঠে।

২০০৪ সালের পর, অধ্যাপক উইলিয়ামস বহুবার কেন্ট দ্বীপে ভ্রমণ করেন, যদিও সে আট-ঘণ্টার শ্রমসাধ্য যাত্রা, সাথে গ্র্যান্ড মানান দ্বীপ অবধি দু’ঘণ্টার ফেরি। তারপর আরও একঘণ্টা লবস্টার নৌকোয় গন্তব্যে পৌঁছান যায়। বোডোইন কলেজের বৈজ্ঞানিক গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রায় ৭০ বছর যাবত সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবেই স্থানটির গুরুত্ব। খোলা-পরিবেশে এমন পরীক্ষাগারে উদ্ভিদ-প্রাণী গবেষণা বিজ্ঞানীদের কাছে আকর্ষণীয় তো বটেই। বোডোইন কলেজের গবেষক নাথানিয়েল হুইলরাইট বহুদিন আগেই সাভানা চড়ুইদের নিয়ে গ্রীষ্মকালে তথ্যসংগ্রহে নামেন। সেই ১৯৮৭ সালে থেকেই, হাজারেরও বেশি ছোট্ট পাখিকে বন্দী করা হয়, পায়ে লাগানো হয় পট্টি এবং সংগ্রহ করা হয় তাদের রক্তের নমুনা। দ্বীপাঞ্চলের চড়ুইদের নিয়ে বিস্তারিত শুমারি বানানো হয়, যাতে তাদের আয়ু-যৌন আচরণ-বসতি সম্পর্কে সচেতনতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আছে।

উইলিয়াম বলছেন, পাখিদের নিয়ে সে এক বহুবছরের গবেষণা; তবে খুব বেশি গবেষনায় এত দীর্ঘকালীন তথ্য ও পদ্ধতির বিস্তার হয়ত নেই, এমনটাও সাথে জানাচ্ছেন অধ্যাপক উইলিয়ামস।

ব্যাপারটাকে কোনও কোনও ক্ষেত্রে ‘মেলরোস প্লেস’-এর জটিল কোনও অধ্যায় মনে হতে পারে। দীর্ঘজীবী এক পুং-চড়ুইকে সেখানে ডাকা হয় এস.আর এন নামে, কারণ তার বাঁ-পায়ে জড়ানো পট্টি আর ডান পায়ে সমুদ্রনীল পট্টির উপর লাল রঙের অন্য একটি। ২০০৪ সালে, পাঁচটি স্ত্রী পাখির সাথে সে মিলিত হয় এবং ২০টি নতুন বাসা তৈরি করে। শেষমেশ রক্তপরীক্ষায় দেখা যায়, মোট ১৬টি আসলে তার নিজের সন্তান আর বাকিরা অন্য পুং-চড়ুইয়ে বাসায় জন্ম নেওয়া শিশু-চড়ুই যাদের সে নিজে পালন করেছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ খবর এই যে, পরের বছর তার ৪ জন সন্তান প্রজনন ঘটায় – ভালো ফলাফলই বলা চলে, কারণ দশটার মধ্যে একটা ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটে থাকে।

 

সাদৃশ্যসম্পন্ন গাইয়ে পাখি ও তাদের গানের নমুনা
বিশেষ গানকে নির্দিষ্ট প্রজাতির সাথে যুক্ত করার প্রচেষ্টা, সেটাও আবার এত বিস্তৃত ও বিবর্তনশীল প্রজাতির মধ্যে – বেশ কষ্টসাধ্য কাজই ছিল। দূরবীন, মাইক্রোফোন আর খানিকটা ধৈর্য নিয়ে, প্রায় একশোর বেশি গানের নমুনাকে তিনি নির্দিষ্ট প্রজাতির সাথে সংযুক্ত করতে সমর্থ হয়েছেন। এই গবেষণায় যদিও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তীব্র সামুদ্রিক বাতাসের শব্দ আর পাখিরাও তাদের পায়ে বাঁধা পট্টি দেখাতে অনেকসময়ই নিমরাজি থেকেছে।

প্রায় সারাজীবন ধরেই পুং সাভানা-চড়ুই অন্যান্য পুং-পাখিদের কাছে শেখা একটি বিশেষ স্বতন্ত্র গানই গাইতে থাকে। চড়ার সুরে গাওয়া গান হয়ত দু’চার সেকেন্ডের ঘটনামাত্র। গানের মূলত চারটি মৌলিক অংশ – তিন থেকে আট স্বরের একটি আলাপ, তীক্ষ্ণ স্ট্যাকাকো স্বরের একটি বিস্তার ও শিষমূলক ধ্বনি, মাঝে দীর্ঘ-কম্পাকের একটি বাঝ এবং সবশেষে দ্রুত কয়েকটি স্বরের প্রক্ষেপ ( যা টার্মিনাল ট্রিল বলেই পরিচিত)।

শব্দের সংগ্রহগুলি নিয়ে প্রোফেসর উইলিয়ামস স্পেক্টোগ্রাম হিসেবেই বিচার করেন, স্বরকে সময়ের বিপরীতে রেখে। কয়েকশো পাখির কয়েকশো গান নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে তিনি এই গানগুলিকে জুড়ে দেখছেন কীভাবে বছরের বিশেষ সময়ে নির্দিষ্ট বয়সের নির্দিষ্ট স্থানে বসবাসকারী পাখির গানে ঠিক কত গভীর বৈচিত্র্য। বৃদ্ধ ও নবীন পাখিদের গানের মধ্যে যে সূক্ষ্মসুন্দর পার্থক্য, বা প্রতিবেশী জায়গাগুলির পাখির গানে যে ফারাক – বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই তিনি এই সুচারু ও বিস্তারিত তথ্যগুলি বিশ্লেষণ করেছেন।

Frequency of bird and his female mate
স্ত্রী পাখিদের সঙ্গি-নির্বাচনের উপলক্ষ্যেই যে শুধু এই গানের বাহার, তা নয় বলেই মতামত হিথার উইলিয়ামসের। বিশেষরূপে স্ত্রী-দের মুগ্ধ করে, এমন কোনো নির্দিষ্ট ধরণের গানের সন্ধান তিনি পাননি। পুরুষের নিখুঁত গায়কীও কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটাও স্পষ্টভাবে বোঝা যায়নি।
অধ্যাপক উইলিয়ামসের মতে, পক্ষীসমাজে তাদের গান হয়ত খুব সহজ ব্যাপারও না। বরং প্রশ্ন ওঠে, গান করার দরকারটাই বা পড়ল কেন ? পরবর্তী কোনো গবেষণায় যদি এই প্রাথমিক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়, হিথারের বিশ্বাস ডারউইনের যৌন-নির্বাচন তত্ত্ব হয়তো পরিশোধনের দাবী রাখবে। ডারউইনের মতে, যৌনসঙ্গীকে আকর্ষণ বা প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্যেই প্রজাতির নারীপুরুষের মধ্যে গঠনগত পার্থক্য বিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু ভিন্ন লিঙ্গের সহযোগী আচরণগুলি নিয়ে নতুন গবেষণার জন্যই ডারউইনের এই তত্ত্বের প্রকৃত পরিমার্জনা দরকার। অধ্যাপক উইলিয়ামস কিছু চরুই-প্রজাতির ক্ষেত্রে দেখেছেন, একদল পুং-পাখি একটি সাধারণ অঞ্চলে বিভিন্ন ইঙ্গিতের দ্বারা স্ত্রী-পাখিকে আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করে, যদিও শেষমেশ হয়তো সামান্য কয়েকটি মিলনের সুযোগই সে পায়।

স্বল্প যোগ্যতার পুরুষ চড়ুইদের মধ্যে সহযোগিতার বাতাবরণে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তত্ত্বের সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যেই, জানাচ্ছেন উইলিয়ামস। সাভানা-চড়ুইদের জন্য হয়তো এই গানের অর্থ অধিক নিগূঢ়। তিনি অনুমান করছেন, এই গানের মাধ্যমেই প্রজাতির পুং-সদস্যরা একধরণের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে উপনীত হয়, যেখানে বয়স বা অবস্থানে পিছিয়ে থাকা সেই দলবদ্ধ পুরুষেরা সমষ্টির বৈশিষ্ট্য হিসেবেই গানকে গ্রহণ করেছে।