ইস্কুলের প্রার্থনার দৃশ্য মনে পড়ে – সুন্দর সারিতে দাঁড়ানো ছাত্রছাত্রীরা গান শেষ হওয়ার পরে, ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়, হট্টগোলের একটা রোজকার উদাহরণ। মানুষের মিছিলে কিংবা গরুর পাল মাঠ থেকে ফেরার সময় – প্রথমে একটা সুষ্ঠু গতিপথ অর্থাৎ নিয়ম বিরাজ করলেও পরে তা আচম্বিতে বেনিয়ম হয়ে যায়। এই যে নিয়মানুগ ব্যবস্থা থেকে মুহূর্তের মধ্যে অরাজকতা তৈরি হওয়া – এই প্রথম গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়েছে এই ঘটনা।
আমেরিকার মিসৌরির সেন্ট লুইসে, ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তি বিভাগের একটি গবেষক দল এ প্রসঙ্গে ‘ফিসিক্যাল রিভিউ ই’ নামক পত্রিকায় কিছু সমীকরণ প্রকাশ করেছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, ক্ষুদ্র পারমাণবিক কণিকা বা ব্যাকটেরিয়া প্রব্রজন থেকে শুরু ক’রে গ্যাসের ছড়িয়ে পড়া, এমনকি স্টক-এক্সচেঞ্জের ওঠানামা – বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে এই প্রবণতা খুবই স্বাভাবিক।
গবেষণার কর্ণধার রাজন চক্রবর্তী বলছেন, সার্বত্রিক এই যদৃচ্ছতা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে এ এক অগ্রণী পদক্ষেপ; বিশৃঙ্খলা তৈরির ঠিক আগের মুহূর্ত ধরার চেষ্টা করা হয়েছে, যাতে এইধরণের ঘটনাকে মানুষ নিয়ন্ত্রণ ও পরিবর্তন করতে পারে।
জলের ভেতরে পরাগরেণুর মতো ছোটো কণার আচরণ, এই যথেচ্ছ গতির এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জায়গায় জায়গায় জলের অণুর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে রেণুগুলি এদিকওদিক ঘুরতে থাকে, এই পাগলাটে গতি ‘ব্রাউনিয়ান মোশান’ নামে পরিচিত। আবার ঠিক এই গতির ফলশ্রুতিতেই কিন্তু এক গ্লাস স্থির জলের মধ্যে একবিন্দু রং সুষ্ঠুভাবে ছড়িয়ে পড়ে, অথবা আমরা উদাহরণ হিসেবে রাখতে পারি পাশের বাড়ির ‘মাংসরন্ধনকালীন ঘ্রাণ’-এর প্রসঙ্গ। ১৯০৫ সালে, আইনস্টাইনই সর্বপ্রথম এই গতির ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।
যেহেতু ব্রাউনীয় গতিতে একসাথে অগুনতি কণা ঘোরাঘুরি করতে থাকে, তাই তা অনিশ্চিত। একমাত্র সংখ্যাতাত্ত্বিক বিবরণ দেওয়া যেতে পারে এই ঘটনার, কণাগুলির গড় গতিবেগের হিসেব কাজে লাগিয়ে। আইনস্টাইন মনে করেছিলেন, ব্রাউনীয় গতির একেবারে শুরুর দিকে কণার আচরণ রৈখিক ও নির্দিষ্ট থাকে, যাকে তিনি ‘ব্যালিস্টিক’ প্রবণতা বলেছেন। যদিও এই ব্যালিস্টিক গতির সন্ধান প্রথম মেলে ২০১১ সালে; ‘অপটিক্যাল ট্র্যাপ’ বা অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তির সুযোগ আইনস্টাইনের সময়ে যেহেতু ছিল না।
নির্দিষ্ট রৈখিক চলন কীভাবে এলোমেলো গতিতে পরিণত হয়, তার পরীক্ষামূলক প্রমাণ গবেষণাগারে পাওয়া গেলেও, এর সঠিক কারণ ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি।
কম্পিউটার মডেল আর নিবিড় গাণিতিক বিশ্লেষণের পর কণার ঘনত্ব, তাদের কার্যকরী আকার এবং নিয়মানুগ গতি থেকে বিশৃঙ্খল হয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সময় – এই তিন রাশির মধ্যে রাজন চক্রবর্তীর গবেষক দল একটি সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। কণার পরিবর্তে ব্যাকটিরিয়া অথবা ভেড়ার দলও হতে পারে আর কার্যকরী আকার বলতে যে কৌণিক অবস্থানে কণাগুলি একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
যেকোনো ইতস্তত গতির ক্ষেত্রেই এই সূত্র প্রয়োগ করে জানা যাবে ঠিক কখন কণাগুলি নিয়ম ভেঙে বেনিয়মের পথে চলতে শুরু করে, সহ-গবেষক পাই লিউ জানাচ্ছেন এমনটাই। চক্রবর্তী মশাই যোগ করেছেন, এমন আরও বিভিন্ন ঘটনার ক্ষেত্রে এই ফর্মুলা ব্যবহার ক’রে দেখা যেতে পারে এটা কতোটা সার্বজনীন। মিসৌরির মেষপালকরা হয়তো দেখবেন এখনও কোনো এক গণিতজ্ঞ তাদের রোজ নজরে রাখছেন!
তথ্যসূত্র : ইউনিভার্সিটি অফ সিডনী