ছোটবেলায় রূপকথার গল্পে মৎস্যকন্যার কথা আমরা সবাই পড়েছি। সেই যে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে মনে হয়, যেন এক সুন্দরী কন্যা হঠাৎ ভেসে উঠল জলের ওপরে। মাথাটা এক কন্যার, নীচের অংশ মাছের মতো। বাস্তবিকই কি তাই? কোনো মনুষ্যপ্রজাতির কন্যা কি থাকতে পারেন সমুদ্রের মধ্যে? না, আসলে ঐ প্রাণীটি একটি সমুদ্রে বসবাসকারী তৃণভোজী প্রাণী, যাকে আবার ‘সমুদ্র-গাভী’ নামেও ডাকা হয়। এই প্রাণীটির নাম ‘ম্যানাটি’ (Manatee)। বর্তমানে এদের তিনটি প্রজাতি জীবিত আছে। একটি হল অ্যামাজেনিয়ান ম্যানাটি, দ্বিতীয়টি ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ম্যানাটি, তৃতীয়টি আফ্রিকান ম্যানাটি। ম্যানাটি লম্বায় বেশ বড়, প্রায় ১৩ ফুট পর্যন্ত। ওজন প্রায় ৬০০ কিলোগ্রামের মতো। শিশু ম্যানাটির ওজন হতে পারে ৩০ কেজির মতো। এদের আছে ‘ক্লিপার’, যা পাটের মতো, যার সাহায্যে এরা সাঁতার কাটে। লেজটি প্যাডেলের মতো। এরা যেহেতু স্তন্যপায়ী, স্ত্রী ম্যানাটির দুটি ক্লিপারের নীচে দুটি স্তন্যবৃন্ত থাকে। এদের ওপরের ঠোঁট খুব বড়ো এবং এটাকে খুব ভালোভাবে এরা নাড়াতে পারে। চোখদুটো খুবই ছোটো, চোখে পাতা থাকে। এদের দাঁতের ব্যাপারটা বেশ আকর্ষণীয়। প্রাপ্তবয়স্কদের incisor বা canine দাঁত থাকে না। ম্যানাটি সাধারণভাবে একা থাকতেই পছন্দ করে। দিনের অর্ধেক সময় এরা জলের নীচে ঘুমিয়ে কাটায়। তবে ২০ মিনিট অন্তর জলের উপরে ভেসে ওঠে। এরা প্রায় ৬০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। ঘণ্টায় প্রায় আট কিলোমিটার গতিতে সাঁতার কাটতে পারে। ম্যানাটি কিন্তু খুব বুদ্ধিমান প্রাণী। এদের স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর, শেখার ক্ষমতাও খুব বেশী। ডলফিনের মতোই মানুষের নির্দেশ এরা বুঝতে ও শিখতে পারে। এরা সাধারণত দু’বছরে একবার প্রজনন ক’রে থাকে। একবারে একটিই বাচ্চা হয়। গর্ভকালীন অবস্থা প্রায় ১২ মাস স্থায়ী হয়। এদের সৃষ্ট শব্দ দিয়ে এরা পরস্পরের সঙ্গে এবং নিজেদের বাচ্চাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম। এদের অন্তঃকর্ণ বেশ বড়ো হলেও বহিঃকর্ণের ছিদ্র খুবই ছোটো। এরা শাকাশী এবং বিভিন্ন ধরনের জলজ গাছপালা খেয়ে বেঁচে থাকে। প্রতিদিন এদের দেহের ওজনের ১০-১৫% ওজনের খাবার খেতে হয়। এরা ক্লিপারের সাহায্যে জলের তলদেশে হেঁটে বেড়ায় এবং খাবার সংগ্রহ করে। ক্লিপারের সাহায্যেই খাবার, গাছপালা ঠোঁটের কাছে আনে এবং ঠোঁটের সাহায্যে মুখের মধ্যে ঢোকায়। ওপরের চোয়ালের শক্ত ‘প্যাড’ এবং নীচের চোয়াল দিয়ে এরা খাবার পেষাই ক’রে থাকে, যেহেতু এদের সামনের দাঁত নেই।
ম্যানাটির বাসস্থান মূলত অগভীর উপকূলবর্তী জলাভূমি; প্রধানত ক্যারাবিয়ান সাগর, মেক্সিকো উপসাগর, আমাজনের তীরবর্তী অংশ এবং পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলভূমি। এরা উষ্ণতর জলে থাকতেই পছন্দ করে এবং অগভীর জলেই থাকে। অল্প লবণাক্ত (Brackish Water) খাঁড়ি অঞ্চলের থেকে মিষ্টি জলের অঞ্চলে প্রবেশ করে এরা; তবে ১৫°c-র কম উষ্ণতায় বাঁচতে পারে না। জর্জিয়ার উপকূল অঞ্চলে এদের দেখা যায়, এটাই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ম্যানাটিজের বিস্তৃতির উত্তরদিকের সীমানা। তবে দীর্ঘদিন ২০°c-র কম তাপমাত্রায় থাকলে ‘cold stress syndrome’–এ এদের মৃত্যু হতে পারে। ফ্লোরিডার ম্যানাটি মিষ্টি জল ও লবনাক্ত জল – উভয় জলেই সাঁতার কাটতে ওস্তাদ। শরীরে জল ও লবণের সঠিক নিয়ন্ত্রণের জন্য এই চলাচল অত্যন্ত জরুরী। ফ্লোরিডার এই অঞ্চলে ম্যানাটির সংখ্যা নিয়ে সার্ভে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে এদের সংখ্যা ছিল ২৬৩৯; ১৯৯৭-র জানুয়ারিতে ২২২৭, ফেব্রুয়ারিতে ১৭৬০; এবং ২০১০ সালের জানুয়ারিতে এই অঞ্চলে পাওয়া গেছে ৫০৬৭টি ম্যানাটি, যা ঐ সময়ে সর্বোচ্চ। বিগত ৪০ বছর ধ’রে ম্যানাটি ছিল ‘endangered’ তালিকাভুক্ত। ২০১৬ র জানুয়ারি মাসে এর সংখ্যা ১৩,০০০ বলা হয়েছে; জানুয়ারি ২০১৬ থেকে তাদের স্ট্যাটাস ‘threatened’। অ্যামাজন নদীতে যে ম্যানাটি দেখা যায়, তারা সম্পূর্ণরূপে মিষ্টিজলে বসবাসকারী। এরা অ্যামাজন ও তার শাখানদীগুলোতেই বিচরণ করে, লবণাক্ত জলে যায় না। ম্যানাটির জনসংখ্যা হ্রাসের প্রধান কারণ মানুষের দ্বারা তাদের বাসস্থান ধ্বংস হওয়া। এছাড়া অসহনীয় তাপমাত্রা, শিশু ম্যানাটির উপর শিকারি প্রাণীর আক্রমণে এদের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এরা জলের মধ্যে খুব ধীরগতিতে চলাফেরা করে। তাই অনেক সময় নৌকার বা জাহাজের প্রপেলারের আঘাতে আহত হয়, অনেকসময় তারা মারাও যায়। ম্যানাটিদের শরীরে অনেক সময়ই প্রপেলারের আঘাতের দাগ বা ঘা দেখা যায়। ক্ষীণ শব্দ এরা শুনতে পায় না। বড়ো নৌকা অনেকসময় যে হর্ন দেয়, তার কম্পাঙ্ক কম থাকায় এরা শুনতে না পাওয়ার কারণে নৌকার কাছাকাছি চ’লে আসে এবং আঘাত পায়। ২০০৩ সালে ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে একটি সমীক্ষা করে। তাতে দেখা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিম আটলান্টিক অঞ্চল, যেখানে প্রচুর সংখ্যায় এদের দেখা যেত, সেখানে উল্লেখযোগ্য হারে এদের সংখ্যা কমে গেছে। এছাড়া হ্যারিকেন জাতীয় ঝড়, ঠাণ্ডার দাপট ও অন্যান্য প্রাকৃতিক কারনেও এরা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বিভিন্ন উপকথায় ছড়িয়ে আছে ম্যানাটির অনেক গল্প। মৎস্যকন্যা হিসাবেই পরিচিতি এদের। এরা যদি প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়, তাহলে আমরা হারাবো একটি সুন্দর প্রাণীকে। তাই দরকার এদের উপযুক্ত সংরক্ষণের ব্যবস্থা। তবেই প্রকৃতিকে টিকে থাকার লড়াইয়ে জিতে যাবে ‘মৎস্যকন্যা’ ম্যানাটি।