মঙ্গল গ্রহে ‘প্রাণ’-এর অস্তিত্ব আছে কি নেই – তা ক্রমশ প্রকাশ্য। বিজ্ঞান নিশ্চয়ই এই প্রশ্নের সদুত্তর দেবে আগামীতে। তবে এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই মহার্ঘ প্রশ্নটি দিনের পর দিন আরও চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠেছে জনমানসে। জনমনগণ এই বিষয়ক যে কোনো উদঘাটনের উৎসুক সঠিক ও পর্যবেক্ষক। তারা একটা চটজলদি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ শুনতে চায় এবং সেই সঙ্গে নিখুঁত প্রমাণ স্পর্শ করতে চায় হাতে গরম। এই ঔৎসুক্য বা অনুসন্ধিৎসা অন্যায্য নয়। কৌতূহলের এই পারদ চড়িয়েছে বিজ্ঞান স্বয়ং।
২৫শে জুলাই ২০১৮, গবেষকরা ঘোষণা করলেন যে, লালগ্রহে চিহ্ন পাওয়া গেছে সুবৃহৎ হ্রদের। মঙ্গলের দক্ষিণ মেরুতে। বরফের পুরু স্তরের নীচে। কয়েক কোটি বছর আগে এই শুষ্ক ও আর্দ্র অঞ্চলে প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে ব’লে ধারণা বৈজ্ঞানিকদের। যদি সত্যিই জলতলের আধার থেকে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই সেখানে মাইক্রোবস, জীবাশ্ম মিলতে পারে বর্তমানে। নাসার প্ল্যানেটরি-র সংরক্ষণ আধিকারিক লিজা প্যাট একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি বলেছেন, প্রথমে একটি পুকুরের মতোই মনে হয়েছিল হ্রদটিকে, তবে এখন আমাদের কাছে রিপোর্ট আছে যে ওটা একটা অব-হিমবাহিক হ্রদ; একে কোনোরকম বাহ্যিক ছোঁয়া থেকে নিরাপদ রাখাই এখন আমাদের কার্যক্রমের লক্ষ্য।
এখন প্রশ্ন হল, কেবলমাত্র একটি হ্রদের সন্ধান পাওয়া আর ‘মঙ্গল গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব’ কি সমার্থক? তাহলে শুরুতেই যে কৌতুহল জাগবে তা হল, কী আছে ঐ হ্রদে? কিছু কি বসবাস করে ওখানে, যাকে আমরা প্রাণের দ্যোতক বলতে পারি। এ-কথা নাসার বিজ্ঞানীরাও স্বীকার করছেন যে, ‘জাগতিক প্রাণ’ বলতে আমরা যা বুঝি তা অবস্থান করার জন্য মঙ্গল-এর এই হ্রদ ও পারিপার্শ্বিক এলাকা পর্যাপ্ত অনুকূল নয়। মাঙ্গলিক বরফের পুরু চাদরের উষ্ণতা মাইনাস ৬৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পৃথিবীতে সর্বনিম্ন মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে। তাহলে আরও মাইনাস ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস শীতলতায় কিছু বেঁচে থাকবে কীভাবে? লিজা প্যাটের বক্তব্যও এমনটাই। তিনিও সন্দিহান এতও শৈত্যে প্রাণধারণ সম্ভব কি না তা নিয়ে। বিজ্ঞানীদের মনে হয়েছে, মঙ্গলের হ্রদগুলিতে প্রচুর পরিমাণে জল রয়েছে। হ্যাঁ, জল। তবে, এত কম তাপমাত্রা হওয়ায় এই জল অবধারিতভাবে অতিরিক্ত লবনাক্ত হবে। জিম বেলা একজন গ্রহবিজ্ঞানী অ্যারিজোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়য়ের বিজ্ঞানী, অন্যধারে প্ল্যানটার সোসাইটির সভাপতি। তিনি বলছেন, জীবের জীবনধারণের জন্য এমন নোনাজল ভীষণ প্রতিকূল। এমনকি কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে যারা চরম পরিবেশেও জীবিত থাকে, তাদের জন্যও এই জলীয় পরিবেশ সহনশীল নয়। তাহলে, তিনি কি মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্বকে উড়িয়ে দিচ্ছেন, নাকচ করছেন সম্পূর্ণ? কিন্তু লিজা বলছেন অন্য কথা। তিনি আশাবাদী। মঙ্গলের জীবরা এমন আবহাওয়ায় বাস করতেই পারে ব’লে তাঁর দাবি।
যদি ধ’রে নেওয়া যায় যে, মঙ্গলে জীবনধারণের উপযোগী অতীত ছিল; তাহলে এটাও মেনে নিতে হবে যে, এমন কিছু প্রাকৃতিক পরিস্থিতি বা ব্যবস্থাপনা ছিল যা ঐ চরমভাবাপন্ন লবণাক্ত জলীয় পরিবেশে প্রাণের যাপনের রক্ষাকবচের কাজ করত। ক্রমপরিবর্তনশীল পরিবেশে যে সুরক্ষা- বন্দোবস্ত হয়তো লুপ্ত হয়েছে বা কোথাও সুষুপ্তিতে অন্তরীণ হয়ে গেছে। রসিকতা ক’রে লিজা প্যাট বলেছেন, আমার কাছে এমন পরিবেশ এক আদর্শ পুনর্বাসনকেন্দ্র। এটা এমন এক জায়গা, যেখানে অনায়াসে ভ্রমনার্থী হওয়া যায় আর উপরিতল কখন আরও সুন্দর ও সাবলীল হয়ে উঠবে তার নিরন্তর প্রতীক্ষা করা যায় এখানে নিঃশব্দে।
আর একটি জিজ্ঞাসা এখানে এসে যায়। সেটা হল, মঙ্গলের এই হ্রদ কতটা আলাদা অন্যান্য প্রাণের সম্ভাবনাময় হ্রদের থেকে? যেমন শনি-র উপগ্রহের এন্সিলাদাসের হ্রদ। এই উপগ্রহের হ্রদেও বিজ্ঞানীরা প্রাণের সম্ভাবনার সন্ধান পেয়েছে। তবে, মহাকাশবিজ্ঞানীদের মতে, বৃহস্পতি বা শনির উপগ্রহের তুলনায় মঙ্গলের বাতাবরণ ও পরিস্থিতি বহুলাংশে সুবিধাজনক। মঙ্গলে অবতরণ সম্ভব হয়েছে। চার-এগারো মাসের মধ্যে মঙ্গল অভিযান সম্পন্ন করা যায়। এমনকি পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদের চেয়ে মঙ্গলে মহাকাশযান অবতরণ করতে পারে তুলনামুলকভাবে অনেক সহজে।
এসবের পরেও যে প্রশ্নটি মহাকাশবিজ্ঞানীদের চিন্তিত করছে সেটা হল, মঙ্গলের হ্রদ কি আদৌ গ্রহটির উপরিতলের সঙ্গে সংযুক্ত? নাকি বিচ্ছিন্ন? শনির উপগ্রহ এন্সিলাদাস বা বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপার বিষয়টি যেমন খানিকটা ভিন্ন। এই উপগ্রহগুলির সমুদ্রের অবতলে সঞ্চিত জমাটবদ্ধ বরফের চ্যুতিরেখা বা ফাটল বরাবর জল ফোয়ারার আকারে মহাকাশে ঝ’রে পড়ে। মহাজাগতিক শত-জল, ঝরনা-ফোয়ারা। কোনো মহাকাশ যান এই জলের কণা অনায়াসে ভাসমান অবস্থাতেই সংগ্রহ করতে পারে।
যদি কোনো মহাকাশযান এখনও অবধি মঙ্গলের হ্রদের তীরের কাছাকাছিও উপস্থিত হতে পারেনি। মঙ্গলে সবসময় ধুলোঝড় প্রবাহিত হয়। বিজ্ঞানীদের ধারনা, এই মহাঝঞ্ঝা প্রাণের অস্তিত্বের দ্যোতক এমন উপাদানগুলিকে স্থানান্তরিত ক’রে ফেলতে পারে। এটা একটা আশঙ্কা। যদি মঙ্গলের হ্রদের নিকটবর্তী কোথাও নামা যেতে পারত, তাহলে গবেষকদের কাজ সহজ হয়ে যেত। লিজা প্যাট বলছেন, মঙ্গলের হ্রদ সত্য হয়ও যদি, এর মধ্যে অনুপ্রবেশের নিশ্চয়ই কোনও সুরক্ষাপথ নেই – এটুকু আশা করা ছাড়া আমাদের আর উপায় কোথায়? তবে, প্রবেশ ও নির্গমনের পথ যদি না থাকে তাহলে আমরা কীভাবে জানতে পারব ঐ হ্রদে কিছু বাস করেছিল? এর উত্তর দিয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী আইজ্যাক স্মিথ। তিনি প্ল্যানেটার সায়েন্স ইন্সটিটিউটের একজন আধিকারিক ও গবেষক। তিনি বলছেন, মঙ্গলের হ্রদে প্রাণের অস্তিত্বের সন্ধান করতে হলে বরফ সমুদ্রকে ড্রিল বা ছিদ্র করতে হবে। এটা কোনো নতুন পদ্ধতি নয়। পৃথিবীতে এর আগে ঘটানো হয়েছে এমন ‘কাণ্ড’। ২০১২ সালে এন্টার্কটিকার ভস্তক হ্রদকে ‘ড্রিল’ করেছিলেন রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা। তারা দাবিও করেছিল যে, এন্টার্কটিকায় ঐ হ্রদটিতে রয়েছে বাস্তুতন্ত্রের জন্য জরুরী নানা উপাদান। পরে তা ভুল প্রমাণিত হয়।
যাই হোক, মঙ্গল গ্রহের মোটা বরফের চাদর ছিদ্র করা প্রযুক্তিবিদদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। শুধু তাই নয়, সমগ্র পৃথিবীর বিজ্ঞানীমহল এই ‘ছিদ্রান্বেষণ’-এর বিরোধিতাও করতে পারেন; যেমনটি করেছিলেন রাশিয়ার ক্ষেত্রে। প্যাটের মতে, এন্টার্কটিকায় অব-হিমবাহিক হ্রদের মতোই মঙ্গল গ্রহের হ্রদটিকেও অমূল্য ও বিশেষ দুর্লভ জায়গা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ফলত সেখানে ছিদ্র করতে উদ্যোগ নিলে বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানিমহল থেকে বিরোধিতার রব উঠবেই। তবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে উপরিভাগ থেকেই বিবিধ চিহ্ন, ইঙ্গিত, ইশারা মিলতে পারে। মঙ্গলের বাতাবরণে মৌসুমী ‘মিথেন ভ্যারিয়েশন’ কার্যত জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আশান্বিত ক’রে তুলেছে। আণুবীক্ষণিক জীবের অস্তিত্ব সম্পর্কে এই বিষয়টিই তাদের আশা জাগিয়েছে। তাদের অনুমান, মঙ্গল-এর উপরিতলের ঠিক নীচে চাপা প’ড়ে থাকতে পারে অণুজীব। একটি ইউরোপীয় ‘স্পেস এজেন্সি এক্সামার্স ট্রেস গ্যাস অরবিটার’ এপ্রিলে মঙ্গল গ্রহে মিথেনের উপস্থিতি সংক্রান্ত তথ্যসংগ্রহ করতে শুরু করে। আশাবাদী তারাও। ইতালির ন্যাশানাল ইন্সটিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্স-এর বিজ্ঞানীরা রবের্তো ওরসেই ভীষণ উত্তেজিত। তিনি বলেছেন, মিথেনের সঙ্গে তরল জলের সম্পর্ক এতটা ঘনিষ্ঠ যে, এটাই প্রমাণ করবে আগামীতে যে, কিছু একটা ঘ’টে চলেছে মঙ্গলের বুকে। কিছু একটা।