বিজ্ঞানের ছোট ছোট গোঁজামিল

বিজ্ঞানের ছোট ছোট গোঁজামিল

অনিন্দ্য পাল
Posted on ১০ এপ্রিল, ২০১৯

স্কুলে বা কলেজের ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানের এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে তথ্যে গোঁজামিল দেয় অনেকেই। মাস্টারমশাই বা দিদিমণিরা যে ব্যাপারটা জানেন না তা একেবারেই নয়, কিন্তু ‘অনেক দিন ধ’রেই এসব চ’লে আসছে’ এই যুক্তিতে তাঁরা দেখেও না-দেখার ভান করেন। বইয়ের লেখা ঠিকঠাক মুখস্থ ক’রে এসে মৌখিক পরীক্ষায় যদি গুছিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে পরীক্ষার্থী, তাহলে আর গোঁজামিল নিয়ে কেউই ভাবতে যান না। কোনো কোনো অধ্যাপক-অধ্যাপিকা ক্লাসে এসে হয়ত বলেন যে, এক্সপেরিমেন্টের সময় সততার সঙ্গে ডেটা নেওয়া উচিত কিন্তু পরীক্ষার সময় এলেই আদর্শ আচরণবিধি থেকে সরতে থাকে ছাত্রছাত্রীরা। পরীক্ষায় নম্বরটাই আসল, সুতরাং কোন বিজ্ঞানী কবে সৎ থেকে এক্সপেরিমেন্ট করেছেন তা ভেবে বিবেকের দংশন বাড়াতে আগ্রহী হয় না কেউই। ঠিক এইরকম একটা পরিস্থিতিতে কেউ যদি পরীক্ষার্থীদের জানায় যে নিউটন, কেপলার, গ্যালিলিও বা মেন্ডেলের মতো দিকপাল বিজ্ঞানীরাও সুযোগ বুঝে তথ্যে কারচুপি করেছেন তবে বিবেক-জ্বালার শেষ বিন্দুটুকুও নিমেষের মধ্যে উবে যাবে। আধুনিক সময়ে বিজ্ঞানীদের অনেক গবেষণাপত্রে ফাঁকিবাজি ধরা পড়ে যাচ্ছে বটে, কিন্তু তাই ব’লে আধুনিক বিজ্ঞানের স্থপতি ব’লে জেনেছি যাঁদের সেই কেপলার বা নিউটনের লেখালেখিতে গোঁজামিল আছে, এই ব্যাপারটা যেন কিছুতেই মেনে নিতে চায় না আজকের মানুষ। কিন্তু কে কী মানল তার উপর নির্ভর করে না বিজ্ঞানের সত্য আর তাই খতিয়ে দেখতে দোষ কোথায়!

১৯৮৮ সালে বিজ্ঞান ইতিহাসকার উইলিয়াম ডনাহু একটা গবেষণাপত্র জমা দেন ‘জার্নাল অফ দ্য হিস্ট্রি অফ অ্যাস্ট্রোনমি’-তে। তাঁর প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘কেপলারস ফেব্রিকেটেড ফিগারসঃ কভারিং আপ দ্য মেস ইন দ্য নিউ অ্যাস্ট্রোনমি’। নিজের তত্ত্বকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করতে গিয়ে জার্মানির জ্যোতির্বিজ্ঞানী যোহান কেপলার কীভাবে তথ্যে কারচুপি করেছেন, কীভাবে তাঁর চার্টে নিজের সুবিধেমতো পরিসংখ্যান ঢুকিয়েছেন, তার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন ডনাহু। মহাবিশ্বের গঠন সম্পর্কিত ধারণায় বিপ্লব এনে দিয়েছে যে সব বই, তার মধ্যে অন্যতম কেপলারের লেখা বই ‘অ্যাস্ট্রোনমিয়া নোভা’ যার ইংরেজি সংস্করণের নাম ‘দ্য নিউ অ্যাস্ট্রোনমি’। এই বইতে গ্রহদের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার ব’লে দাবি করেন তিনি। এতদিন ধ’রে চ’লে আসা বৃত্তাকার কক্ষপথের ধারণা থেকে এটা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। ফলে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্যগত প্রমাণ ছাড়া এটাকে বিশ্বাসযোগ্য ক’রে তোলা সম্ভব ছিল না। তথ্য আসবে গ্রহদের গতি পর্যবেক্ষণ ক’রে, সেই পর্যবেক্ষণে পাওয়া সংখ্যাই শেষ কথা বলবে কেপলারের নতুন তথ্য সম্পর্কে – এটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু নিজের কাছে তথ্য সংগ্রহের যা পথ ছিল, তা দিয়ে তাঁর নতুন তত্ত্বকে সমর্থন করার মতো ডেটা জোগাড় করতে পারেন নি কেপলার। তাই সম্ভবতঃ চরম উদ্বেগের অবস্থায় তথ্যের গোঁজামিল ঘটিয়েছিলেন। কেমনভাবে ঘটল ব্যাপারটা? ইতিহাসে যাওয়া যাক।

জার্মানির ওয়েল ডার স্টাডে ১৫৭১ সালে জন্ম কেপলারের। সময় ও সমাজের রীতি মেনে যাজকবৃত্তির জন্য পড়াশোনা করেছিলেন তিনি, স্থানীয় গির্জায় নিয়োগও পেয়েছিলেন। যাজক হয়েই হয়ত সারা জীবন থেকে যেতে হত কেপলারকে, যদি না গ্রাজ শহরের লুথেরান স্কুলে একটা শূন্যপদ সৃষ্টি হত। সেখানে জ্যোতির্বিদ্যা পড়াতে শুরু করলেন তিনি। একই সঙ্গে অবশ্য জ্যোতিষের কাজও চলতে লাগল চালুপ্রথা মেনে। শোনা যায় লগ্ন-রাশির প্রায় আটশো ছক তৈরি করেছিলেন কেপলার। তিনি যে খুব বস্তুবাদী ছিলেন তাও নয়। এমন বেশ কিছু ধারণা ছিল তাঁর, যা আজকের ভাষায় ‘অলৌকিক’ বা হয়ত ইংরেজি শব্দ ব্যবহার ক’রে বলা যায় ‘মিস্টিক’। এর মধ্যে একটা হল মহাবিশ্বের মধ্যে চরম শৃঙ্খলার ভাবনা। এই ধরণের ভাবনা তাঁর সময়ের অনেক চিন্তাবিদের মধ্যেই ছিল। সবাই যে ঈশ্বরের কল্পনা ক’রে নিতেন তা হয়ত নয়, তবে জীব ও জড় জগতের মধ্যে একটা সমন্বয় সৃষ্টিকারী সূত্রের কথা নানাভাবে ঘুরত তাঁদের মাথায়। যাই হোক, এই ভাবনার বশেই কেপলার হয়ত গ্রহদের চলাচলের মধ্যে সমন্বয়কারী সূত্র খুঁজতে শুরু করেছিলেন।

নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) পৃথিবী-কেন্দ্রিক ধারণা ভেঙে দিয়ে সূর্য-কেন্দ্রিক ধারণার প্রচলন ঘটাতে চেয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক এক কাজ। আপাতভাবে যা স্বাভাবিক মনে হয়, অর্থাৎ সবকিছুর কেন্দ্রে পৃথিবী, তার থেকে স’রে এসে সূর্যকে কেন্দ্রে স্থাপন করতে গিয়ে ধর্মের প্রতিনিধিদের আক্রোশের মুখেও পড়তে হয়েছিল কোপার্নিকাসকে। তবে তিনি গোলাকার কক্ষপথের ধারণা থেকে সরেন নি। এদিকে মানুষ চোখে যেভাবে দেখছে গ্রহদের গতিবিধি, তার কিছুকিছু ব্যাপার খুব ভালো ব্যাখ্যা করতে পারেন নি কোপার্নিকাস। মানে সেই সময়ের অন্যান্য ব্যাখ্যার তুলনায় তাঁর ব্যাখ্যা খুব বেশি কার্যকরী হয় নি। আমরা জানি, কখনও কখনও আপাতভাবে গ্রহদের পেছনে সরতে দেখা যায়। পঞ্জিকায় এটাকেই বলা হয় বক্রী, ইংরেজিতে রেট্রোগ্রেড। এর জন্য গোলাকার কক্ষপথের মধ্যেই আরও ছোট ছোট গোলাকার পথ, ইংরেজিতে এপিসাইকেলের ধারণা চালু ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের তত্কালীন ধারণায়। কোপার্নিকাস আরও জটিলভাবে সেগুলোকে ব্যবহার ক’রে তাঁর তত্ত্ব সাজালেন কিন্তু তাতে যে পর্যবেক্ষণের সঙ্গে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে মেলানো গেল তা নয়। এই জায়গা থেকেই নিজের গবেষণা শুরু করেছিলেন কেপলার।

১৬০০ সালে ডেনমার্কের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ টাইকো ব্রাহে কেপলারকে আমন্ত্রণ জানালেন প্রাগ শহরের বাইরে তাঁর নিজস্ব মানমন্দিরে গবেষণার অংশীদার হতে। টাইকো ছিলেন বেশ ধনী এবং সে সময়ের ভাষায় যাকে বলে নোবেলম্যান। কেপলারকে তিনি মঙ্গলের গতিপথ নিয়ে কাজ করার সুযোগ দিলেন। এই কাজের ফলেই কেপলারের মনে ‘দ্য নিউ অ্যাস্ট্রোনমি’ লেখার বাসনা জাগল। মঙ্গলের গতিপথকে প্রতিনিধি ধ’রে নিয়ে তিনি অন্যান্য গ্রহের চলার পথ বিশ্ববাসীকে জানাবেন ব’লে ঠিক করলেন। কেপলার তাঁর যে তত্ত্ব দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন সেটার মূল কথা ছিল, গ্রহদের গতিপথ উপবৃত্তাকার। কোপার্নিকাসের গোলাকার পথের ধারণা থেকে তিনি স’রে এসেছিলেন আগেই। ইতিহাসকার ডনাহু লিখেছেন যে, ১৬০৫ সালের শুরুতে নিজের বইয়ের একান্নটা অধ্যায় লিখে ফেলেছিলেন কেপলার, উপবৃত্তাকার গতিপথের প্রমাণ না-পেয়েই। এপ্রিল মাস নাগাদ তাঁর মনে সেই বিদ্যুৎ ঝিলিক খেলে গেল, যা প্রায় সব মহান আবিষ্কারের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। টাইকোর তথ্য ঘেঁটে তিনি বুঝতে পারলেন যে, তাঁর আগের ভাবনা ঠিক! সূর্য থেকে কোনো গ্রহ অবধি একটা সরলরেখা টানা হলে একই সময়ের ব্যবধানে সেটা একই ক্ষেত্রফল পরিক্রমা করে। অর্থাৎ সূর্যের কাছে থাকলে গ্রহের গতি অনেক বেশি হয়। এই সূত্র যখন মানছে গ্রহের দল তখন অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে গ্রহের গতিপথ কখনই বৃত্তাকার নয়। সেটা উপবৃত্তাকার! সত্তরটা অধ্যায় সমৃদ্ধ ‘দ্য নিউ অ্যাস্ট্রোনমি’ ১৬০৯ খৃষ্টাআব্দে প্রকাশিত হল হাইডেলবার্গে। সবাই যে ধন্য ধন্য করলেন তা একেবারেই নয়। কিন্তু কিছু প্রশংসাও পেল এই বই। আলোচনা সেটা নিয়ে নয়। ডনাহুর আগ্রহ ছিল এই বইয়ে ব্যবহৃত তথ্য নিয়ে।

একেবারে মূল লেখাটা পড়বেন মনস্থির ক’রে ডনাহু ল্যাটিন ভাষায় পড়লেন কেপলারের যুগান্তকারী গ্রন্থ। তেপ্পান্ন নম্বর অধ্যায়ে এসে একটা খট্‌কা তৈরি হল তাঁর। এখানে কেপলার পৃথিবী আর মঙ্গলের দূরত্ব মাপছেন বিভিন্ন তারিখে। যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন এর জন্য তা আজ আর অচেনা নয়। একে বলে ‘ট্রায়াঙ্গুলেশন’। এই পদ্ধতিতে দুটো বিন্দুর দূরত্ব মেপে নেওয়া হয় প্রথমে। তারপর তৃতীয় একটা বিন্দুর দূরত্ব মাপা হয় তিন বিন্দুর সমন্বয়ে যে ত্রিভুজ তৈরি হচ্ছে তার কোণের বিশ্লেষণ ক’রে। ডনাহু বুঝতে চাইলেন ব্যাপারটা। নিজে নিজে ক’রে দেখলেন অঙ্কগুলো, কিন্তু কোনোভাবেই কেপলারের চার্টের সংখ্যার সঙ্গে মিলল না সেগুলো। বিকল্প পথও অবলম্বন করলেন, কিন্তু তাতেও গরমিল। অনেক খাটাখাটনির পর তিনি ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন যে, সংখ্যা বা তথ্যগুলো আসল নয়! বরং ক্ষেত্রফলের সূত্রের সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে সংখ্যাগুলো বসানো হয়েছে। অর্থাৎ নিজের তত্ত্ব প্রমাণ করতে গোঁজামিল দিয়েছেন কেপলার। ডনাহু নিজে ইতিহাসকার আর তাই জানেন ইতিহাস সৃষ্টিতে কেপলারের ভূমিকার কথা। শ্রদ্ধাশীল হয়েই তিনি বলেন যে, এইটুকু গোঁজামিলে কেপলারের মহান ভূমিকার গুরুত্ব সামান্যতম কমে না। তবে সত্যি যেটা তা তো আর চট্‌ ক’রে অস্বীকার করা যায় না। যতদিন না কেউ ডনাহুকে ভুল প্রমাণ করছেন ততদিন কেপলারের এই গোঁজামিল নথিবদ্ধ থাকবে।

এমনই গোঁজামিল আর এক দিকপালের কাজে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। তিনি স্বয়ং নিউটন! মার্কিন গবেষক রিচার্ড ওয়েস্টফল সাফল্যের-খোঁজে-পাগল আইজ্যাক নিউটনকে তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে। ১৯৮০ সালে নিউটনের যে জীবনী প্রকাশ করেন তিনি, তার নাম দেন ‘নেভার অ্যাট রেস্ট’। বিজ্ঞানের ধারণায় বিপ্লব আনা নিউটনের বই ‘প্রিন্সিপিয়া’ বিশ্লেষণ ক’রে ওয়েস্টফল বলেন যে, নিজেকে নিখুঁত প্রমাণ করার চেষ্টায় নিউটন সুকৌশলে তথ্য জাল করেন। তাঁর তত্ত্বের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায় যেগুলো, পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া এমন তথ্যকেই কেবল বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেন নিউটন। যেসব তথ্য নিয়ে তাঁর অসুবিধে হত, সেগুলো বাদ দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না তিনি। বই থেকে এলোমেলো অনেক উদাহরণ হয়ত দেওয়া যায় কিন্তু শব্দের গতিবেগ নিয়ে কাজটা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। বায়ুর মধ্যে দিয়ে শব্দের চলাচল পরিমাপ করতে গিয়ে তাত্ত্বিক দিকে নিউটনের কোনো ভুল হয় নি। শব্দকে স্থিতিস্থাপক বায়ু মাধ্যমের কম্পনের ফসল ব’লে ধ’রে নেন তিনি। শব্দের এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় পাড়ি দেওয়ার সময় বায়ুমাধ্যমের স্থিতিস্থাপকতা আর ঘনত্বের অনুপাতকে সমূহ গুরুত্ব দেন নিউটন। এভাবেই গতির পরিমাপ পাওয় যাবে ব’লে জানান তিনি। এতে কোনোরকম অসঙ্গতি ছিল না। কিন্তু দুটোর অনুপাত থেকে যখন তিনি শব্দের গতি মাপলেন তখন দেখলেন যে কুড়ি শতাংশের গরমিল হচ্ছে। তখন পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া তথ্য আর তত্ত্বের মধ্যে গরমিলকে সামাল দিতে দু’দুটো গোঁজ দিলেন আইজ্যাক নিউটন। দুটোই কিন্তু ছিল কাল্পনিক! প্রথমত তিনি ধ’রে নিলেন যে বায়ুর কণার মধ্যেকার ফাঁকা অঞ্চল দিয়ে যাওয়ার সময় শব্দের গতিবেগ থাকে একটা সীমার মধ্যে। কিন্তু যেই কোনো বায়ুর কণা সামনে পড়ে গেল অমনি শব্দ অসীম গতিতে বেরিয়ে যায় তার মধ্যে দিয়ে। তাই কণাগুলো ঠিক যতটা আয়তন দখল ক’রে থাকে তার উপর ভিত্তি ক’রে একটা গোঁজ ফ্যাক্টর ঢুকিয়ে দেন নিউটন। আর একটা গোঁজ ছিল বায়ু আর বাষ্পের মিশ্রণ নিয়ে। নিউটন বলেন যে, আমাদের চারদিকে শুধু যে বায়ু ঘিরে রয়েছে তা নয়। তার সঙ্গে মিশে রয়েছে বাষ্প যা শব্দের চলাচলে বাধা দেয়। এর ফলে শব্দ আরও দ্রুতবেগে চলতে থাকে। তাই তিনি সংশোধন হিসাবে আর একটা গোঁজ ঢোকালেন। এই দুটো গোঁজ ব্যবহার করার ফলে তাঁর বন্ধু উইলিয়াম ডারহামের মাপা শব্দের গতির সঙ্গে একেবারে ঠিকঠাক মিলে গেল তত্ত্ব থেকে পাওয়া গতি। পুরোপুরি ১১৪২ ফিট প্রতি সেকেন্ডে! (আজকের মাপের সঙ্গে এটা কিন্তু মিলবে না।) প্রিন্সিপিয়ার এই অংশটাকে সব থেকে গোলমেলে ব’লে আখ্যা দিয়েছেন রিচার্ড ওয়েস্টফল। এই দুটো গোঁজ ব্যবহার করার আগে কোনোরকম বাস্তব পরীক্ষা করেন নি নিউটন! স্রেফ কল্পনার ভিত্তিতে এগুলোকে ঢুকিয়ে নিজের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাকে সফল ব’লে দেখাতে চেয়েছিলেন নিউটন।

এই বিষয়টা ছাড়া আরও বেশ কয়েকটা ক্ষেত্রে গোঁজ ব্যবহার করেন নিউটন। চাঁদের উপরে কতটা মহাকর্ষ বল কাজ করছে, নদীতে জোয়ারের উচ্চতা কত হবে বা নিরক্ষরেখায় পৃথিবীর স্ফীত হয়ে থাকার পরিমাণ – এইসব ক্ষেত্রে মূল পদার্থবিজ্ঞানটা ধ’রে ফেললেও তাঁর কাছে উপযুক্ত তথ্য ছিল না যেগুলো পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া গিয়েছে। আঙ্কিক ভিতটা তখনও তৈরি করে উঠতে পারেন নি নিউটন। তাই হয় তিনি গোঁজ ঢোকালেন আর নয়ত তাঁর তত্ত্বের সঙ্গে যে তথ্য খাপ খায় শুধু সেগুলোকেই নিলেন বেছে। ওয়েস্টফল ছাড়াও যাঁরা নিউটনের এই গোঁজামিলের প্রবণতা লক্ষ্য করেছেন তাঁরা একটা ব্যাপারে খুব নিশ্চিত। সেটা হল, ভুলক্রমে নিউটন করেন নি এগুলো। এত বেশি বার এমন গোঁজ ঢুকেছে তাঁর বইতে যে ভুল বুঝে তিনি এটা ক’রে ফেলেছেন, এমন ধারণাটা কোনোভাবেই তৈরি হতে পারে না!

সুতরাং ছোট আকারে হোক বা তার থেকে কিছুটা বড়, গোঁজামিল ব্রাত্য ছিল না বিজ্ঞানের সুদীর্ঘ ইতিহাসে!