ঠিক যেন মানুষেরই মতো – কাটলফিশও তৈরি করতে পারে ‘মিথ্যা স্মৃতি’

ঠিক যেন মানুষেরই মতো – কাটলফিশও তৈরি করতে পারে ‘মিথ্যা স্মৃতি’

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২ আগষ্ট, ২০২৪
কাটলফিশ

স্মৃতি ভ্রংশ আর অপভ্রংশের স্মৃতি এর মধ্যে তফাৎ আছে। এই যেমন কেউ বাড়ি থেকে বেরনোর আগে চাবিটা রাখলেন ফ্রিজের মাথায়। অথচ সারা ঘর তোলপাড় করে খুঁজে ফেললেও একটা বার ভাবলেন না ফ্রিজের কথা। হয়ত তার টুকরো স্মৃতি ভ্রংশ ঘটেছে – ওখানে যে একটা ফ্রিজ আছে সেটাই সে ভুলে গেছে। আবার অন্যদিকে অপভ্রংশের স্মৃতি বা মিথ্যা স্মৃতি তাকে জানান দিচ্ছে আর যাই হয়ে যাক চাবিটা ফ্রিজের মাথায় কিছুতেই সে রাখতে পারেনা, তাই ওখানে দেখার চেয়ে সারা ঘরের সম্ভাব্য জায়গাগুলো ঘেঁটে ফেলা ভালো। এই চিত্র অনেকের কাছে নতুন নয়। মানুষের মগজ এমন মিথ্যা স্মৃতি বানাতে পারে। আমাদের মস্তিষ্ক টুকরো টুকরো ছবির কোলাজে স্মৃতি বানায়। তাতে গন্ধ থাকে, স্বর থাকে, অনুভুতি থাকে। যখন আমরা স্মৃতিগুলো পুনঃস্মরণ করার জন্য সেগুলোকে পুনর্গঠন করি তখন তা অনেকসময় এলোমেলো হয়ে ‘মিথ্যা স্মৃতি’ তৈরি হয়। তবে গবেষণা বলছে, মানুষের মতোই কাটলফিশের মধ্যেও এই মিথ্যা স্মৃতি দেখা গেছে।

অনেকটা পেছনের দিকে তাকালে, একটি পূর্বপুরুষ খুঁজে পেতে পারি যা থেকে আমাদের মূলোৎপন্ন। বিবর্তনের ধারা মেনে এই পূর্বপুরুষ অবশেষে প্রাণীদের দুটি প্রধান দলে বিভক্ত হয়: মেরুদণ্ডযুক্ত (মানুষ) এবং মেরুদণ্ডহীন। মেরুদণ্ডবিহীন প্রাণীদের দলে, কিছু সত্যিকারের স্মার্ট প্রাণী আছে যাদেরকে সেফালোপড বলা হয়। অক্টোপাস, স্কুইড এবং কাটলফিশ এরা হল সেফালোপড গোষ্ঠীর। মানুষের চিন্তাভাবনার অনুরূপ জটিল মস্তিষ্ক, যা এদেরকে ভালভাবে মনে রাখতে এবং সমস্যার সমাধান করতে সাহায্য করে। ২০১২ সালের সমীক্ষায় দেখা গেছে যে সাধারণ কাটলফিশ REM বা র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট ঘুমের মধ্য দিয়ে যায়। এটা স্মৃতির স্থিতিশীলতার সাথে সম্পর্কিত একটা পর্যায়। বর্তমানের এক গবেষণা বলছে, কাটলফিশের মধ্যেও এই মিথ্যা স্মৃতির উপস্থিতি কাটলফিশ (সেপিয়া অফিশনালিস) ও তার ঘনিষ্ঠ সেফালোপড অক্টোপাস ও স্কুইডের বুদ্ধিমত্তাকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করতে পারে। ফ্রান্সের কেন নরম্যান্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোইথোলজিস্ট লিসা পন্সেটের নেতৃত্বে গবেষণায় বলা হচ্ছে কাটলফিশের চাক্ষুষ মিথ্যা স্মৃতি তৈরি হয়, কিন্তু তাদের ঘ্রাণজনিত মিথ্যা স্মৃতি গঠিত হয়নি।

অতীতের পরীক্ষায়, কাটলফিশ বুদ্ধিমত্তার কিছু চমত্কার প্রমাণ দেখা গেছে। যার মধ্যে মানব-শিশুদের জন্য ডিজাইন করা একটি বোধ-পরীক্ষায় তারা উত্তীর্ণ হয়। এমনকি তাদের আকার চিনতে এবং খাবারের সাথে সেই আকারের মিল বোঝার জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে বলে জানানো হয়। বর্তমান গবেষকরা, কাটলফিশকে একের পর এক অনুরূপ আকারের স্ন্যাকসের তিনটে টিউব দেন। সেই তিনটে টিউবের একটাতে কাঁকড়া (যা কাটলফিশের বিশেষ পছন্দের খাবার না হলেও তারা খায়), অপরটায় চিংড়ি মাছ (কাটলফিশের পছন্দের খাবার) আর শেষেরটা খালি রাখা হয়। প্রতিটা স্ন্যাকসের টিউবকে কিছু নির্দিষ্ট প্যাটার্ন দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। তাদের তীক্ষ্ণ, নির্দিষ্ট, এবং বিস্তারিত মেমরি স্মরণের ঘটনা দেখা গেছে। এই সামুদ্রিক প্রাণীরা মনে করতে পারে তারা কী খেয়েছিল, কোথায় খেয়েছিল, কখন খেয়েছিল; যা এপিসোডিক মেমরি হিসেবে পরিচিত। পরীক্ষায় কাটলফিশদের স্ন্যাকসের টিউব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল। কেউ কেউ বিভ্রান্তিকর ঘটনার মুখোমুখি হয়েও প্রভাবিত হয়নি, কিন্তু কিছু কাটলফিশের মিথ্যা স্মৃতি তৈরি হয়েছিল। এই ঘটনাটি সাধারণত আমাদের নিজস্ব প্রজাতির মধ্যে পাওয়া যায় যেখানে এই সংবেদনশীলতা ব্যক্তিবিশেষে পরিবর্তিত হয়। এই গবেষণা আইসায়েন্সে প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × 4 =