মহামারির প্রাদুর্ভাব বাড়ছে?

মহামারির প্রাদুর্ভাব বাড়ছে?

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
মহামারির প্রাদুর্ভাব বাড়ছে?

মহামারি, সংক্রামক রোগ আবার বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন মহামারির প্রত্যাবর্তন ঘটছে। মধ্যযুগে ব্ল্যাক ডেথ বা প্লেগ, তারপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে স্প্যানিশ ফ্লু লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার ফলে টীকাদান পদ্ধতিতে গুটিবসন্ত নির্মূল করা গেছে, পোলিও প্রায় নেই বললেই চলে। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যাচ্ছে, এবং সম্প্রতি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধের ব্যবহারও হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আবার মহামারির প্রকোপ ফিরে আসছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। ১৯৮০-র দশকে এইচআইভি/এইডস, তারপরে বেশ কয়েকটি ফ্লু মহামারি, সার্স এবং এখন কোভিড। না, কোভিড একেবারে শেষ হয়ে যায়নি বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। এখন প্রশ্ন হল কেন এমন ঘটছে? ভবিষ্যতে মহামারি এড়াতে আমরা কি কিছু করতে পারি?
স্বাস্থ্যকর, স্থিতিশীল বাস্তুতন্ত্র, খাদ্য এবং বিশুদ্ধ জল, অক্সিজেন, সবুজ পরিবেশ আমাদের সুস্থ রাখে। বাস্তুতন্ত্রের আর একটি প্রধান কাজ হল রোগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করা। যখন প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় থাকে – শিকারী তৃণভোজীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে, আবার তৃণভোজীরা উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে – তখন মহামারি সৃষ্টির লক্ষ্যে প্যাথোজেনের উদ্ভব আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
কিন্তু যখন মানুষের ক্রিয়াকলাপের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হয়, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয় তখন বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য ব্যহত হয়। যেমন, জলবায়ু পরিবর্তন উদ্ভিদ এবং প্রাণীর সংখ্যা ও বাসস্থানকে প্রভাবিত করে। পৃথিবী উষ্ণ হওয়ার সাথে সাথে মশা বাহিত রোগ গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চল থেকে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে তার প্রভাব ফেলতে শুরু করে এবং অসময়ে আরও বেশি মানষকে সংক্রামিত করে। উষ্ণায়ণের ভেলকিতে মশারা তাদের বেঁচেবর্তে থাকার উপায় খুঁজে নেয়। গবেষকরা চিনের আবহাওয়া এবং ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণের মধ্যে সম্পর্ক অধ্যয়ন করে দেখেছেন জলবায়ু পরিবর্তন ডেঙ্গুর সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি করছে। খাদ্য শৃঙ্খল ব্যাহত করে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি একই রকম প্রভাব ফেলতে পারে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যখন পশুপালকরা তাদের গবাদি পশুদের চরানোর জন্য দক্ষিণ আমেরিকায় জঙ্গল পরিষ্কার করে ফেলেছিল, তখন বনে বসবাসকারী রক্তচোষা বাদুড়েরা খাবারের জন্য এক জায়গায় বসে থাকা বড়োবড়ো প্রাণীদের উপর আক্রমণ করতে থাকে। দক্ষিণ আমেরিকায় এই প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এই বাদুড়গুলো জলাতঙ্ক রোগের ভাইরাস বহন করে, যা আক্রান্ত মানুষের মধ্যে প্রাণঘাতী মস্তিষ্কের সংক্রমণ ঘটায়। যদিও দক্ষিণ আমেরিকায় টীকাদান কর্মসূচির কারণে বাদুড়-জনিত জলাতঙ্ক থেকে মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে, তবুও অন্যান্য প্রাণীর কামড়ের ফলে সৃষ্ট জলাতঙ্ক এখনও বিশ্বব্যাপী ভীতির কারণ। যেহেতু শহরাঞ্চলের বিস্তার এবং কৃষি উন্নয়ন প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের উপর প্রভাব ফেলছে, মানুষ এবং গৃহপালিত প্রাণীদের প্যাথোজেন দ্বারা সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। আগে এই জীবাণু সাধারণত শুধুমাত্র বন্যপ্রাণীতে সংক্রামণ ঘটাতে দেখা যেত। আফ্রিকাতে এইচআইভি ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ঘটে যখন মানুষ বনমানুষকে জবাই করে। সেই সময় এই ভাইরাস মানুষের রক্তে সংক্রামিত হয় এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে ভ্রমণ ও বাণিজ্যের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। গবেষকদের মতে এই মহামারি আমাদের পৃথিবীতে ততক্ষণ ঘটতে থাকবে যতক্ষণ আমরা আমাদের পরিবেশকে প্রভাবিত করছি। বিশ্ব উষ্ণায়ণে তাপমাত্রা বাড়ছে পৃথিবীর। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভেক্টরবাহিত রোগ বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি, জনসংখ্যার স্থানচ্যুতি, ভ্রমণ এবং বাণিজ্য রোগের প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এখন মানুষের হাতেই লাগাম, মহামারির কারণ অনুধাবন করে তারা কীভাবে তার মোকাবিলা করবে।