অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বর মধ্য দিয়ে ইউরোপে রোগ-জীবাণু ভিত্তিক আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের পত্তন হয় উনিশ শতকে। এখানে “আধুনিক” চিকিৎসাবিজ্ঞান বলতে আমরা সেই ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতি বোঝাচ্ছি, যা আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাগুলির (যথা পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান প্রভৃতি) পদ্ধতিতন্ত্রর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উনিশ শতকের ইউরোপে এর প্রধান স্থপতিরা ছিলেন: ক্লোদ বের্নার (Claude Bernard, ১৮১৩-১৮৭৮), রুডল্ফ কার্ল ভির্চফ (Rudolf Carl Virchow, ১৮২১-১৯০২), লুই পাস্তুর (১৮২২-১৮৯৫), জোসেফ লিস্টার (১৮২৭-১৯১২) আর রবার্ট কখ (১৮৪৩-১৯১০)।
বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ যাতে বিষয়নিষ্ঠ (অবজেকটিভ) হয়, সেজন্য ক্লোদ বের্নার ‘ব্লাইন্ড এক্সপেরিমেন্ট’ পদ্ধতির কথা বললেন। এই পদ্ধতিতে পরীক্ষাটিকে সবরকম ব্যক্তিগত পক্ষপাত থেকে মুক্ত রাখার জন্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনোকিছু জানতে দেওয়া হয় না। শুধু তাই নয়, বের্নার শরীরের অভ্যন্তরীণ পরিবেশের একান্ত নিজস্ব ভারসাম্য (milieu intérieur )-র ধারণাটির প্রবক্তা। ওই ভারসাম্য বজায় থাকে বলে আমরা অবাধে দিব্যি চলেফিরে বেড়াতে পারি, নানান পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারি। শরীর সর্বদাই ওই অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে চায়। অথচ ওই ভারসাম্য রক্ষার জন্যই শরীরকে বাইরের পরিবেশের সঙ্গে নিরন্তর ক্রিয়া-বিক্রিয়া চালাতে হয়। বের্নার-এর কাজের ভিত্তিতেই গড়ে উঠল আধুনিক শারীরতত্ত্ব আর প্রাণরসায়ন।
১৮৫৭ সালে লুই পাস্তুর রোগের কারণ হিসেবে জীবাণুকেই শনাক্ত করলেন। আর ১৮৫৮ সালে রুডল্ফ কার্ল ভির্চফ দেহকোষ-ভিত্তিক প্যাথলজির প্রবর্তন করলেন। দুয়ে মিলে চিরকালের মতো রোগের প্রাচীন গ্রীক ‘হিউমার’ বা রস-তত্ত্বর সমাধি রচনা করে দিল।
১৮৬৭-তে কিছু পরিমাণে পাস্তুরের কাজের ভিত্তিতে প্রকশিত হল জোসেফ লিস্টারের Antiseptic Principle of the Practice of Surgery. ফেনল (কার্বলিক অ্যাসিড) ব্যবহার করে ক্ষত জীবাণুমুক্ত রাখা এবং শল্যযন্ত্র জীবাণুমুক্ত করার পদ্ধতি অস্ত্রোপচার-পরবর্তী সংক্রমণের হার ব্যাপকমাত্রায় কমিয়ে দিল। অবশেষে ১৮৭০ সালে লুই পাস্তুর এবং রবার্ট কখ-এর হাতে রোগের জীবাণুতত্ত্ব অবিসংবাদিত প্রতিষ্ঠা লাভ করল। অ্যানথ্রাক্স নিয়ে কাজ করে কখ দেখালেন, কীভাবে একটি নির্দিষ্ট জীবাণু একটি বিশেষ রোগের কারণ হয়ে ওঠে। ১৮৮৪ সালে তিনি ভারতে এসে কলেরার ব্যাসিলাস-কে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেন। কখ যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণুরও আবিষ্কারক। ১৮৭৯ থেকে ১৮৮১ সালের মধ্যে পাস্তুর কয়েকটি ভ্যাকসিন প্রস্তুত করতে সমর্থ হলেন। সেটাও আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক দিক্চিহ্ন।
পাস্তুর যে বছর মারা যান, সেই বছরই, ১৮৯৫ সালে কনরাড রয়েন্টগেন-এর এক্স-রশ্মির আবিষ্কার। অতঃপর ১৯০১ সালে ঘটল কার্ল ল্যান্ডস্টাইনার-এর রক্ত-গ্রুপ আবিষ্কার। মোটামুটি এই ক-টি আবিষ্কার আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ধারা বদলে দিল।
সুস্থ দেহ, অসুস্থ দেহ, অসুখ, সুস্থতা প্রভৃতি নিয়ে, বিশেষ বিশেষ রোগের উপসর্গ নিয়ে, শারীরসংস্থান ও শারীরতত্ত্ব নিয়ে আগে প্রচুর মূল্যবান কাজ হয়েছে; কিন্তু সেগুলো ছিল, জে ডি বার্নালের ভাষায়, বড়োজোর “আধা-বিজ্ঞান”। যেমন পারদঘটিত মলম প্রয়োগ করে সিফিলিসের (ষোড়শ শতক), কিংবা সিনকোনা গাছের ছালের সাহায্যে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা (সতেরো শতক)। এসব আবিষ্কারের পিছনে ছিল না কোনো স্বীকৃত তত্ত্ব। এবার রোগ-জীবাণু তত্ত্ব সেই অভাবটা মেটাল। নিছক উপসর্গ-বিচারেই সীমাবদ্ধ না-থেকে চিকিৎসাশাস্ত্র এবার সংক্রমণের কারণ ও উৎস সন্ধানে ব্রতী হতে পারল। এর আগে, আশু সংক্রমণ ঘটলে শরীরের মধ্যে ঠিক কী ঘটে, তা নিয়মবদ্ধ উপায়ে জানা সম্ভব ছিল না। এবার অবস্থাটা ব্যাপকভাবে বদলে গেল। তার পিছনে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের অবদানও অসাধারণ। বলা বাহুল্য, এর পরেও সমস্যা রইল; শরীরের অভ্যন্তরীণ বিপাক-ক্রিয়া ঘটিত কারণে যেসব রোগ হয়, তার জন্য অন্য অনুসন্ধান-পদ্ধতির প্রয়োজন হল।
তবে বৈজ্ঞানিক অর্থে যতই অবিসংবাদিত হোক, বাস্তবক্ষেত্রে এই নতুন রোগজীবাণু তত্ত্বর সবচেয়ে বড়ো বিরোধী ছিলেন খোদ ডাক্তাররাই। পাস্তুরের এবং লিস্টারের পরামর্শমতো ন্যূনতম জীবাণু-নাশক ব্যবস্থা চালু করতে রাজি ছিলেন না হাসপাতালগুলোর বেশির ভাগ ডাক্তার, যেহেতু ব্যাপারটা তাঁদের দীর্ঘ-অনুশীলিত প্রক্রিয়ার এবং ধ্যানধারণার সঙ্গে বেমানান। পাস্তুরের কালঘাম ছুটে গিয়েছিল তাঁদের রাজি করাতে গিয়ে। আমূল নতুন কোনো কিছুকে গ্রহণ করার পথে এই প্রাতিষ্ঠানিক অনীহা, এমনকী প্রতিরোধ, একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেটা বাস্তবের নিকষে সত্য এবং মানুষের পক্ষে মঙ্গলকর বলে প্রমাণিত, সেটাই জয়ী হয়। তার জন্য লড়াই করতে হয়, শুধু বৈজ্ঞানিক জ্ঞানবুদ্ধির লড়াই নয়, সংগঠিত সামাজিক লড়াই। পাস্তুর সেটা করেছিলেন। তাই তিনি চিরপ্রণম্য।