মস্তিষ্ক-বিকাশ: প্রকৃতি, না লালনপালন?

মস্তিষ্ক-বিকাশ: প্রকৃতি, না লালনপালন?

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

জন্মের আগেই জিনঘটিত নানান প্রক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠে মস্তিষ্কের স্নায়ু-ক্রিয়ার নানারকম ছাঁদ। আর সেগুলোই প্রাথমিকভাবে মস্তিষ্ক-বর্তনীসমূহের সংযোগ-জালগুলি গড়ে তোলে। এর পরের পর্বটি হল জন্মের পর লালনপালনের পর্ব। এই পর্বে নানাবিধ অভিজ্ঞতার চাপে স্নায়ু-ক্রিয়ার ওই ছাঁদগুলি থেকে জন্ম নেয় নতুন নতুন ছাঁদ। এই দুটো পর্ব খুব স্পষ্টভাবেই আলাদা হওয়া সত্ত্বেও ঠিক কোন পর্বে কী ঘটে সে বিষয়ে আমাদের ধারণা এখনো বেশ অস্পষ্ট।
ঠিক সেই কাজটা করবার চেষ্টা করেছেন ম্যাক্স প্লাঙ্ক ফ্লোরিডা ইন্সটিটিউট ফর নিউরোসায়েন্স, ফ্রাঙ্কফুর্ট ইন্সটিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ আর ফ্রাঙ্কফুর্টের গ্যেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলিত প্রয়াসে ডঃ ডেভিড ফিট্‌জপ্যাট্রিক আর ডঃ মাথিয়াস কাশ্চুবে-র নেতৃত্বে একদল স্নায়ুবিজ্ঞানী। এই উদ্দেশ্যে এঁরা নেউল জাতীয় প্রাণীর মস্তিষ্কবল্কলের দৃষ্টিশক্তি সংক্রান্ত এলাকাটির নিউরনগুলির প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করেছেন। প্রাণীটির বিকাশের তিনটি পর্ব নিয়ে কাজ করেছেন তাঁরা – চোখ-ফোটার আগের পর্ব; ২) দৃষ্টি-অভিজ্ঞতা হওয়ার একেবারে আদি পর্ব ; ৩) পরিণত দৃষ্টিশক্তি। পর্ব ১-এর সংযোগ-জালিকাসমূহের স্বতঃস্ফূর্ত ক্রিয়ার ছাঁদগুলির সঙ্গে তাঁরা পর্ব ২-এর একেবারে আদি স্নায়বিক সাড়াগুলির ছাঁদগুলির তুলনা করেছেন। দেখা গেছে, এইসব আদি দৃষ্টি-অভিজ্ঞতা, দৃষ্টি-বর্তনীগুলিতে যেসব সক্রিয়তা জাগিয়ে তোলে তাদের সঙ্গে চোখ-মেলার আগের পর্বের স্বতঃস্ফূর্ত ক্রিয়াকর্মের ছাঁদের তফাত আছে। তাছাড়া একই দৃষ্টি-চিত্র বারবার দেখানো হলেও, প্রতিবারই আলাদা আলাদা ক্রিয়া-ছাঁদ ফুটে ওঠে। এমনকী একেকটি স্বতন্ত্র নিউরনের ক্রিয়াও পরীক্ষানিরীক্ষার বিবিধ পর্যায়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিংবা সুস্থায়ী হয় না। অথচ পরিণত দৃষ্টি-ক্রিয়া প্রক্রিয়াকরণ ইউনিটে ওই একই দৃশ্য দেখালে যে-সাড়া জাগে তার ক্রিয়াকর্ম কিন্তু সুস্থিত। সেখানে মাত্র কয়েক দিনের দৃষ্টি-অভিজ্ঞতা অর্জনের পরেই একই দৃশ্য বারবার দেখালে একই নিউরনগুলি ঠিক একই ছাঁদে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর ফলে তথ্যকে কম্পিউটার-বোধ্য শক্তপোক্ত রূপ দেওয়া সম্ভব হয়। দৃষ্টি-অভিজ্ঞতা হওয়ার পরে বর্তনীতে যেসব ক্রিয়াকর্মের ছাঁদ ফুটে ওঠে সেগুলি নানাবিধ দৃশ্য-উৎসারিত কর্মকাণ্ডের ছাঁদের সঙ্গে মিলে যায়। তবে আগের প্রাথমিক দৃষ্টি-অভিজ্ঞতা না থাকলে কিন্তু ক্রিয়াকাণ্ডের ছাঁদগুলি সুস্থায়ী হয় না, সেগুলি স্বতঃস্ফূর্ত ক্রিয়াকণ্ডের ছাঁদের সঙ্গে মেলেও না। অভিজ্ঞতা-উত্তর সুস্থায়ী ছাঁদগুলি আগেকার জাগিয়ে-তোলা ছাঁদ আর স্বতঃস্ফূর্ত ছাঁদ, কোনোটার সঙ্গেই মেলে না। যার অর্থ, আদি দৃষ্টি-অভিজ্ঞতা, স্নায়ু-বর্তনীগুলোর সংস্থানের মধ্যে বিকাশগত কিছু পরিবর্তন ঘটিয়েছে আর তারই ফলে সুস্থায়ী সক্রিয়তার অভিনব সব ছাঁদ তৈরি হয়েছে। সংযোগ-জালিকায় ঠিক কোন কোন পরিবর্তনের ফলে নির্ভরযোগ্য সাড়া জাগে তা অবশ্য এখনও অনিশ্চিত। তবে কম্পিউটারের সাহায্যে একটি মডেল বানিয়ে সেটিকে জীববৈজ্ঞানিক উপাত্তর (ডেটা) সঙ্গে তুলনা করে কতকগুলি সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস পাওয়া গেছে; এবার সেগুলির ঠিক-ভুল যাচাই করা হচ্ছে। ডঃ ফিট্‌জপ্যাট্রিক ব্যাখ্যা করে বলেছেন, স্নায়ু-বর্তনীসমূহের প্রাথমিক ধর্মগুলিকে পরিণত বর্তনীতে রূপান্তরিত করার পথে দৃষ্টি-অভিজ্ঞতার একটা জোরালো ভূমিকা থাকে। এই প্রক্রিয়াটিতে অভিজ্ঞতার ভূমিকা কী, তা বুঝতে পারলে মস্তিষ্ক-বর্তনী বিকাশের মৌলিক ক্রিয়াপদ্ধতিগুলি অনুধাবন করা যাবে। বিকাশ-ঘটিত ত্রুটিগুলিকে অনুধাবন ও প্রশমিত করার জন্য এই ক্রিয়াপদ্ধতিগুলিকে বোঝা অত্যন্ত জরুরি।
সূত্র: Sigrid Trägenap, David E. Whitney, David Fitzpatrick & Matthias Kaschube (2024). The developmental emergence of reliable cortical representations. Nature Neuroscience. doi.org/10.1038/s41593-024-01857-3.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twelve − three =