মৌমাছিদের গোপন বৈদ্যুতিক বাস্তুতন্ত্র

মৌমাছিদের গোপন বৈদ্যুতিক বাস্তুতন্ত্র

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

মৌমাছি ক্ষুদ্রাকার প্রাণী। সেন্টিমিটার-দীর্ঘ ডানায় ভর করে নিজের শরীরের ভার বয়ে, আমাদের এই ‘দৈত্যাকার’ জগতে অনায়াসে ঘুরে বেড়ায়। তবে, মানুষের অনুভূতির চেয়েও তাদের সংবেদনশীলতা অনেক প্রসারিত। অনন্য বর্ণ ও আকার সনাক্তকরণে তাদের পাঁচটি চোখ এবং সুদূরের ফুলের গন্ধ আহরণে, তাদের শুঁড়টি যেভাবে সাহায্য করে তা বেশ চমকপ্রদ।
মৌমাছিদের একটি অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় আছে, যা মানুষের নেই – বিজ্ঞানীরা এই নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভাবছেন এবং সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন। অতিরিক্ত ইন্দ্রিয়ের কাজটি হল – স্থিরতড়িৎ সনাক্ত ও ব্যবহার করা। উড়ে যাওয়ার সময় এই মৌমাছিরা স্থির বিদ্যুৎ সঞ্চয় করে। তাদের চারপাশের বস্তুগুলিকে বায়ুর মাধ্যমে অনুভব করতে এবং প্রভাবিত করতে এই ক্ষমতা যথেষ্ট শক্তিশালী হতে পারে। ইল, হাঙর এবং ডলফিনের মতো জলজ প্রাণীরা জলে বিদ্যুৎ অনুভব করতে পারে। জল বিদ্যুৎ পরিবাহী পরিবেশ। বিপরীতে, বাতাস একটি দুর্বল পরিবাহক। মৌমাছির বিদ্যুৎ অনুভব করার এই সম্ভাবনাটি বিবর্তনীয় অভিpযোজনের আকর্ষণীয় দিক। ২০১৩ সালে, ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্সারি ইকোলজিস্ট ড্যানিয়েল রবার্ট তাঁর ল্যাবরেটরি আবিষ্কার করেন, মৌমাছিরা ফুল থেকে বিকিরিত বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র শনাক্ত এবং পার্থক্য করতে পারে। পরবর্তীতে, নানা পরীক্ষায় দেখা যায়, মাকড়সা, টিক (‘এঁটুলি’) এবং অন্যান্য পোকামাকড় একই ধরনের কৌশল ব্যবহার করতে পারে। এই স্থিরবিদ্যুৎ বাস্তুতন্ত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এঁটুলি এবং গোল কৃমির মতো পরজীবীরা তাদের আশ্রয়দাতা বড় প্রাণী থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ আহরণ করে। বেলুনিং নামে পরিচিত আচরণ মারফত, মাকড়সারা আকাশে বিদ্যুৎচার্জ ধরার জন্য একটি সিল্কের সুতো বাড়িয়ে উড়ে যায়। কখনও কখনও বাতাসের সঙ্গে শত শত কিলোমিটার ভ্রমণ করে। ২০০৫ সালে, রবার্টের ল্যাব থেকে গবেষণায় উঠে এসেছে কীভাবে প্রজাপতি এবং মথ স্থির বিদ্যুতের সাহায্য নিয়ে পরাগ আকর্ষণ করে। শিকারী থেকে বাঁচতে সাহায্য করতে পারে। নতুন গবেষণাটি শুধুমাত্র স্থির বিদ্যুতের পরিবেশগত প্রভাবই নথিভুক্ত করছে না, এই বৈদ্যুতিক অনুভূতিকে, পতঙ্গরা সূক্ষ্মভাবে কার্যকরী করে তুলছে কিনা এবং করলেও কীভাবে করছে, তাও বিশ্লেষণ করছে। ক্ষুদ্র প্রাণীদের টিকে থাকার জন্য ‘স্থিরবিদ্যুৎ’ বিবর্তনীয় শক্তির তুল্য প্রমাণিত হতে পারে। যে শক্তি তাদের খাবার খুঁজতে, স্থানান্তরিত হতে এবং অন্য জীবদের সংক্রামিত করতে সাহায্য করে। বায়বীয় বিদ্যুৎ গ্রহণ (ইলেক্ট্রোরিসেপশন) নামে পরিচিত এই ঘটনা প্রকৃতি জগতে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। রবার্ট জানিয়েছেন, পোকামাকড় এবং মাকড়সাদের মধ্যে স্থির বিদ্যুৎ শনাক্তকরণ এবং সঞ্চয় কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং বিবর্তনের ফল। ভাল ইলেক্ট্রোরিসেপশন যুক্ত মাকড়গুলি বেঁচে থাকলে এবং প্রজনন করলে, তখন সেটা তাদের জিনের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠবে। পরবর্তী প্রজন্মে এগুলি আরও শক্তিশালী এবং ব্যাপক হয়ে উঠবে। বাম্বলবি নামক সামাজিক মৌমাছিরা অন্যান্য কলোনির সদস্য এবং লার্ভাদের জন্য খাবার সংগ্রহ করে। খাদ্য সংগ্রহকারীরা প্রতিদিন ফুল সম্পর্কে শত শত সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যান্য মৌমাছিরা সেই সিদ্ধান্তগুলির উপর নির্ভর করে। “আমরা ব্যক্তিগত স্তরে একটি বেশ সূক্ষ্ম পার্থক্য লক্ষ্য করেছি। সেকেন্ডের তফাতে দ্রুত ফুল শনাক্ত করতে পারার ব্যাপারটা বিবর্তনগতভাবে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।” – বলেছেন মৌমাছি বিশেষজ্ঞ ডর্নহাউস । তিনি আরও বলেন, যদি স্থিরবিদ্যুৎ পরাগায়নে সহায়তা করে, তবে তা উদ্ভিদের বিবর্তনকেও পরিবর্তন করতে পারে। “ফুলের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য আসলে সঠিক স্থিরবিদ্যুৎ ক্ষেত্র তৈরি করার জন্যই হয়েছে।” ধারণাটি অবাস্তব নয়। ২০২১ সালে, রবার্টের গবেষক দল লক্ষ্য করেন, মৌমাছির মতনই সমবৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত পোকামাকড়কে আকর্ষণ করতে পিটুনিয়া ফুল একপ্রকার যৌগ নিঃসরণ করে। ফুলগুলি পরাগায়নকারীর জন্য অপেক্ষা করে। তাঁরা জানান, ফুল শক্তিশালী অদৃশ্য সংকেত প্রেরণ করে, যেমন গন্ধ বা অতিবেগুনি প্যাটার্ন। “এমন হতে পারে যে কিছু ফুলের ক্ষেত্রে, বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র আসলে মৌমাছিদের কাছে রঙের চেয়েও বেশি জোরালো সংকেত।
তবে, আমরা সব সময় পরিবেশে স্থিরবিদ্যুতের জিনিস ব্যবহার করছি। ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, বিদ্যুৎ লাইন, সার এমনকি পোশাকেও স্থির চার্জ রয়েছে। পোকামাকড়রা সংবেদনশীল হওয়ায় তারা বিদ্যুৎ লাইনের প্রতিও সংবেদনশীল হয়ে পরে, এইভাবে আমরা সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটিকে বিভ্রান্ত করে তুলছি। এ বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন যা অনেক ছোট প্রাণীদের বিবর্তনীয় রহস্য খুঁজে বের করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 × one =