জাতীয় বিজ্ঞান দিবস

জাতীয় বিজ্ঞান দিবস

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

এক তরুণ ভারতীয় বিজ্ঞানী জাহাজে করে বিলেত থেকে ভারতে ফিরছেন। ভূমধ্যসাগরের ওপর দিয়ে আসবার সময় আকাশের নীল আর সমুদ্রের নীল দেখে তিনি মুগ্ধ। দেখতে দেখতে মনে প্রশ্ন জাগল, আচ্ছা, সমুদ্রের জল আসলে তো নীল নয়। এক বালতি জল যদি সমুদ্র থেকে তুলে নিই, সেটা তো সাধারণ জলেরই মতন দেখতে লাগে। তাহলে সমুদ্রের মধ্যে জলের রং নীল দেখায় কেন? প্রশ্নটা ভাবাল তাঁকে। তিনি জানতেন, লর্ড রেলি নামে এক মস্ত বিজ্ঞানী বলেছেন, সাগরের জলে আকাশের নীল রংয়ের প্রতিফলন হয় বলেই জলটা নীল দেখায়। তরুণটির মনে প্রশ্ন জাগল, তাই কি? ব্যাপারটা কি এতটাই সরল? নাকি এর মধ্যে আরও বড়ো কোনো রহস্য আছে?
তরুণটির নাম চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরামণ। তিনিই ভারতের একমাত্র নোবেল-বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী। রামণের জন্ম তামিল নাড়ুর তিরুচিরাপল্লিতে। আট ভাইবোন তাঁরা। বাবা খুবই শিক্ষিত মানুষ, পেশায় এক সাধারণ ইস্কুলের শিক্ষক। খুবই ছাপোষা পরিবার। ছেলেটি অসম্ভব মেধাবী। মাত্র ১১ বছর বয়সে মাধ্যমিক, ১৩ বছর বয়সে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করল। দুটোতেই ফার্স্ট। ভালো স্কলারশিপ পেল। কলকাতার মতন চেন্নাইতেও আছে প্রেসিডেন্সি কলেজ। খুব নামকরা কলেজ। সেখান থেকে ১৯০৪ সালে ষোলো বছর বয়সে বি এ পাশ করলেন রামণ। এবারেও ফার্স্ট। পদার্থবিজ্ঞান আর ইংরিজিতে সোনার পদক পেলেন। মাত্র আঠেরো বছর বয়সে, ১৯০৬ সালে, পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর একটা গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হল ইংল্যান্ডের বিখ্যাত পত্রিকা ফিলজফিক্যাল ম্যাগাজিনে। ১৯০৭ সালে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথারীতি প্রথম হয়ে এম এ পাশ করলেন।

রামণের খুব ইচ্ছে, এবার বিলেত গিয়ে উচ্চতর বিজ্ঞান চর্চা করবেন। কিন্তু বাদ সাধলেন ডাক্তার। এতই রোগাপাতলা চেহারা তাঁর যে বিলেতের হাড়কাঁপানো শীতে নাকি তিনি নির্ঘাৎ যক্ষ্মা হয়ে মারা যাবেন! অতএব কী আর করা! তিনি অন্য একটা পরীক্ষায় বসলেন। তাতেও যথারীতি ফার্স্ট। সরকারি অর্থবিভাগে খুব বড়ো চাকরি পেয়ে এলেন কলকাতায়। কলকাতা তখন ভারতের রাজধানী। সেটা ১৯০৭ সাল। বিজ্ঞানচর্চা আর হবে না, ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল তাঁর।
একদিন সকালে ট্রামে করে অফিস যাবার পথে কলকাতার বউবাজার মোড়ে দেখলেন একটা বাড়ির সামনে একটা সাইনবোর্ডে ইংরিজিতে লেখা রয়েছে, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স। ট্রাম থেকে নেমে পড়লেন রামণ। ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কি বিজ্ঞানের গবেষণা হয়? তার জন্য যেসব যন্ত্রপাতি, বইপত্র দরকার, সেসব আছে? পরিচালক বললেন, দেখুন বইপত্রর অভাব নেই, তবে যন্ত্রপাতি আপনাকে তৈরি করে নিতে হবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পরামর্শে শেষ পর্যন্ত ঠিক হল, সকাল বেলা অফিস যাওয়ার আগে, আর সন্ধেবেলা অফিস ছুটির পরে রামণ সেখানে এসে গবেষণা করবেন।
আলোকের ওপর গবেষণা করে ১৯১১ সালে নেচার পত্রিকায় বেরোল তাঁর প্রবন্ধ। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে যোগ দিতে বললেন। মাইনে কিন্তু সরকারি চাকরির অর্ধেকও নয়! টাকার লোভ সামলে বিজ্ঞানকেই বেছে নিলেন রামণ। ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেট দিল।
গানবাজনাতেও তাঁর খুব ঝোঁক। সুর জিনিসটা কী? একটা বেহালা যন্ত্রর সুরধ্বনি অন্য কোনো বাজনার সঙ্গে মেলে না কেন? তানপুরা থেকে যে-সুরেলা গুঞ্জন ওঠে তার কারণ কী? পিয়ানো যন্ত্রর সুর আবার একেবারে আলাদা। তবলা কিংবা মৃদঙ্গ বাজালে যে বিচিত্র ধ্বনি বেরোয়, তারই বা কারণ কী? চলল রামণের গবেষণা। কয়েকটি প্রবন্ধও বেরোল। কিন্তু এরপর তিনি আস্তে আস্তে ধ্বনিবিজ্ঞান ছেড়ে আলোকবিজ্ঞানের গবেষণায় আগ্রহী হলেন।
১৯২৪ সালে বিলেতের রয়্যাল সোসাইটি তাঁকে ‘ফেলো’ করে নিল। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় জিজ্ঞেস করলেন, এবারে তোমার পরিকল্পনা কী? রামণের সটান উত্তর, ‘নোবেল পুরস্কার, আর কী?’ ১৯২৬-এ ছাপা হল তাঁর এক বিখ্যাত প্রবন্ধ। সমুদ্রের জল কেন নীল দেখায়? আলোর রং নির্ভর করে আলোর ঢেউগুলো কত ছোটো বা বড়ো তার ওপর। বড়ো হলে রং ক্রমশ লালচে হতে থাকবে। আর ছোটো হলে ক্রমশ নীলচে দেখাবে। তিনি দেখালেন, জল থেকে যে-আলো ঠিকরে বেরিয়ে আসে তার ঢেউ কিন্তু বাতাস থেকে জলের ওপর আছড়ে-পড়া আলোর ঢেউয়ের চেয়ে ছোটো। সেই জন্যই তার রং নীল। কিন্তু ঢেউগুলো ছোটো হয়ে যায় কেন? রামণ প্রমাণ করলেন, জলের অণুগুলো আলোর চলার পথকে বেঁকিয়ে দেয় বলেই এই কাণ্ডটা ঘটে। লর্ড রেলির পুরোনো ব্যাখ্যা বাতিল হয়ে এই নতুন ব্যাখ্যা সারা পৃথিবীতে মান্য হল।
আবিষ্কারের দিনটা ছিল ২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৮। পয়লা মার্চ, কলকাতার দ্য স্টেট্‌সম্যান কাগজে খবর বেরোলঃ কলকাতার এক অধ্যাপকের নতুন আবিষ্কার – পরমাণুর ধাক্কায় ঘুরে গেল আলোর পথ । ৮ মার্চ রামণ এই আবিষ্কারের একটা ছোটো বিবরণ লিখে পাঠিয়ে দিলেন বিলেতের নেচার কাগজে। সেটা ছাপা হল ২১ এপ্রিল। সারা পৃথিবীতে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। রামণের খ্যাতি আকাশ ছুঁল। এই নতুন আবিষ্কারটা রামণের নামেই রামণ ক্রিয়া বলে পরিচিত হল, ইংরিজিতে Raman Effect.
আজও প্রতি বছর আমরা ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখটিকে ‘বিজ্ঞান দিবস’ বলে পালন করি। কারণ ২৯ ফেব্রুয়ারি যে প্রতি চার বছরে একদিন করে আসে।
১৯৩০ সালে নোবেল পুরস্কার পেলেন রামণ।
কী ধরনের যন্ত্র নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন রামণ? সেটা শুনলে আজকের দিনে আমাদের হাসি পাবে। তিনি রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘এর জন্য আমার দুশো টাকাও খরচ হয়েছিল কিনা সন্দেহ’। একটা পারদ-আর্কবাতির সাহায্যে একটা স্বচ্ছ পদার্থের ওপর একরঙা আলো ফেলে ওই যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা আর মাপজোক করতেন তাঁরা। আলোকরশ্মি কীভাবে বেঁকে যাচ্ছে তার ফটো তুলতেন। এই সামান্য যন্ত্রর সাহায্যেই এমন অসামান্য গবেষণা তিনি করতে পেরেছিলেন।

রামণের গবেষণার যন্ত্র।
বিজ্ঞানই ছিল তাঁর ধর্ম। বিজ্ঞান ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম তিনি মানতেন না। বলতেনঃ
স্বর্গ নেই, নরক নেই, পুনর্জন্ম নেই, অবতার নেই, অমরত্ব নেই। একমাত্র ঘটনা এই যে মানুষ জন্মায়, বাঁচে, মারা যায়। সুতরাং, মানুষের উচিত ঠিকভাবে জীবনটা কাটানো।

১৯৭০-এর ২১ নভেম্বর এই মহান বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × one =