অদৃশ্য কিন্ত অমোঘ ‘ওয়ালেস রেখা’

অদৃশ্য কিন্ত অমোঘ ‘ওয়ালেস রেখা’

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৫ মার্চ, ২০২৫

১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস (১৮২৩-১৯১৩) মালয় দ্বীপপুঞ্জের একটি কুটিরে বসে ম্যালেরিয়া জ্বরে ভুগতে ভুগতে চার্লস ডারউইনকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠির উপজীব্য তাঁর এক আশ্চর্য উপলব্ধি। ওয়ালেস বছরের পর বছর ওই অঞ্চলের প্রজাতিগুলির উপর গভীর দৃষ্টিপাত করে তাদের নথিবদ্ধ করেন। এই সময় তাঁর উপলব্ধি হয় যে প্রজাতি-জগৎ নিরবচ্ছিন্ন নয়, এদের মধ্যে এক অদৃশ্য বিভাজন আছে। এটি আসলে পূর্বে এবং পশ্চিমে দুটি আলাদা জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে বিভক্ত। আগে প্রচলিত ধারণা ছিল, প্রজাতিগুলি স্থিতিশীল এবং পরিবেশগত অবস্থার ভিত্তিতে তাদের অবস্থান। পৃথিবীর ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াগুলি এখানে কম গুরুত্ব পেয়েছে। সংকীর্ণ ২১ মাইল প্রশস্ত সমুদ্রের ওই অংশটি লোম্বক প্রণালী নামে পরিচিত, বালি এবং লোম্বক দ্বীপকে ওটি আলাদা করে রেখেছে।

প্রজাতিগুলিকে ওয়ালেসের এই সূক্ষ্ম নথিভুক্তকরণ আগের ধারণাকে পাল্টে দিল । তিনি লক্ষ্য করেন, নিকটবর্তিতা এবং পরিবেশগত সাদৃশ্য সত্ত্বেও, এই দুটি দ্বীপের প্রাণীকুল ব্যাপকভাবে ভিন্ন। ওয়ালেস রেখার পশ্চিমে বোর্নিও, সুমাত্রা এবং জাভায় এশীয় প্রাণীদের দেখা যায়। যেমন, বাঘ, গণ্ডার, হাতি এবং বানর। পূর্বদিকে লেসের সুন্দা দ্বীপপুঞ্জ, সুলাওয়েসি এবং নিউ গিনিতে পাওয়া যায় অস্ট্রেলীয় প্রজাতির প্রাণী । যেমন, পসাম, বনের মধ্যে কোলের থলিতে রেখে বাচ্চা মানুষ -করা মার্সুপিয়াল, কাকাতুয়া , লরিকীট এবং কাঁটাওয়ালা ইকিডনা প্রভৃতি ডিম দেওয়া স্তন্যপায়ী প্রাণী। এই বিভাজনটি কেন হল , তা বোঝার জন্য আমাদের সমুদ্রের তলদেশের ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে, কারণ মাছ এমন একটি প্রাণী যারা অবাধে এই কাল্পনিক রেখা পার হয়ে যায়। হিমযুগে যখন সমুদ্রপৃষ্ঠের স্তর নেমে গিয়েছিল, তখন ভূমি সেতু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দ্বীপকে মূল ভূখণ্ডের সাথে সংযুক্ত করেছিল, ফলে প্রজাতিদের অবাধ স্থানান্তরণ সহজ হয়। কিন্তু এই লোম্বক প্রণালীর গভীর জল কখনও শুকিয়ে যায়নি। এটি একটি দুর্ভেদ্য বাধা হিসেবে রয়ে যায়। ফলস্বরূপ, লোম্বক প্রণালী প্রজাতিদের পার হতে বাধা দিয়ে, দুটি পৃথক বিবর্তনের জগতকে স্বাধীনভাবে বিকশিত হতে দেয়।
ওয়ালেস রেখার দুই পাশে থাকা প্রাণীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা যায়। কাঁকড়া-খাওয়া ম্যাকাক পশ্চিমে পাওয়া যায় এবং অত্যন্ত অভিযোজনক্ষম । আবার বুটেড ম্যাকাক যা পূর্বে সুলাওয়েসিতে পাওয়া যায়, তা ঘন বনাঞ্চলের জন্য অভিযোজিত হয়েছে। এই ওয়ালেস রেখা তাদের আচরণগুলিকেও ভিন্ন আকার দিয়েছে । কাঁকড়া-খাওয়া ম্যাকাকরা সুযোগসন্ধানী এবং প্রায়ই ফসলের ওপর ও মানব বসতিতে হানা দেয়। বিপরীতে, বুটেড ম্যাকাকরা নিভৃতচারী, সুলাওয়েসির বনের নির্জন সম্পদের উপর নির্ভরশীল । সুন্দা ফ্রগমাউথ (ব্যাট্রাকোস্টোমাস কর্নুটাস), দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রাপ্ত একটি রাত্রিচর পাখি। এটি এক প্রাচীন বংশের অন্তর্গত যা মূলত সুন্দা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। এর অভিযোজন ঘন উষ্ণমন্ডলীয় বনে জীবন ধারণের জন্য তাদের উপযুক্ত করে তোলে। সেখানে এরা অনিন্দ্য ছদ্মবেশের উপর নির্ভর করে সুরক্ষিত থাকতে পারে। এছাড়া, ফ্রগমাউথ পাখির মধ্যে পার্থক্যও দেখা যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রাপ্ত সুন্দা ফ্রগমাউথ এবং অস্ট্রেলিয়ায় প্রাপ্ত টনি ফ্রগমাউথের (পোডারগাস স্ট্রিগোইডস) মধ্যে জীবন যাপনের ধরণ এবং অবস্থানগত পার্থক্য রয়েছে। এই ফ্রগমাউথ বংশধারার মধ্যে পার্থক্য সেই অলিগোসিন যুগ থেকে, যা প্রায় ৩০-৪০ মিলিয়ন বছর আগে শুরু হয়েছিল। ওয়ালেস রেখার মধ্যে পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন মেরুদণ্ডী বিভাজনের মধ্যে একটি হল এই ফ্রগমাউথ। বাদুড় একটি স্থলজ প্রাণী, যা কিছুক্ষেত্রে এই প্রতীকী জীবভৌগোলিক সীমানার ব্যতিক্রম। কিছু বাদুড় প্রজাতি, যেমন ‘উড়ন্ত শিয়াল’, ওয়ালেস রেখার উভয় পাশেই পাওয়া যায়। এরা খাদ্য এবং বাসস্থানের সন্ধানে অনেক দূর ভ্রমণ করতে পারে। ওয়ালেসের এই রেখা-বিভাজন, জীবনের বৈচিত্র্যকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। কিছু প্রাণী এই রেখা অতিক্রম করতে সক্ষম হয় এবং নতুন পরিবেশে অভিযোজিত হতে পারে। অন্যরা তাদের নির্দিষ্ট পরিবেশের সাথে সমন্বয় করে চলতে থাকে। এ ঘটনা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কীভাবে পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক বাধা প্রাণীদের বিবর্তনকে প্রভাবিত করে। প্রকৃতির এই অসীম বৈচিত্র্য আমাদেরকে জীবনের প্রতি এক নতুন দৃষ্টিকোণ দেয় না কি ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

11 + 3 =