পুরোনো বিজ্ঞান ও আধুনিক বিজ্ঞান

পুরোনো বিজ্ঞান ও আধুনিক বিজ্ঞান

মীরা নন্দা
বিজ্ঞান ও ইতিহাস দর্শনের স্বতন্ত্র গবেষক
Posted on ১৪ মার্চ, ২০২৫

ইউরোপে বিজ্ঞান-বিপ্লব ঘটার পর ষোলো থেকে আঠেরো শতকের মধ্যে যে-বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটল তা প্রকৃতিকে অনুধাবনের প্রয়াসে মানুষের যাবতীয় পুরোনো উদ্যোগের থেকে একেবারে আলাদা। যেসব বৈপ্লবিক পরিবর্তন আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মের সঙ্গে জড়িত, সে সম্বন্ধে অধিকাংশ বিজ্ঞান-ইতিহাসবিদ একমত:
1. প্রকৃতিকে গাণিতিক রূপদান। অর্থাৎ প্রাকৃতিক বস্তু এবং ঘটনাগুলিকে গণিতিক ভাষায় পরিমণাত্মক রূপ দিয়ে ব্যাখ্যা করার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা। এর জন্য উত্তরোত্তর নিখুঁত মাপনীযন্ত্র ব্যবাহার করা হল, যথা ঘড়ি, কম্পাস, থার্মোমিটার, ব্যারোমিটার ইত্যদি।
2. প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি তথ্যানুসন্ধানী পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো। আধুনিক যুগের প্রথম দিকে বিজ্ঞানীদের (যাঁদের কুলনায়ক হলেন গ্যালিলিও) হাতে প্রকৃতির এই গাণিতিক রূপদানের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষাসাধন মারফত সমন্বিত হল।
3. বিশ্বের একটি যান্ত্রিক চিত্র নির্মাণ, যা প্রাকৃতিক জগতের ক্রিয়াপ্রক্রিয়াগুলিকে কেবল গতিশীল কণার নিরিখেই ব্যাখ্যা করতে চাইল।
4. কায়িক শ্রমকে অভূতপূর্ব মূল্যদান, যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়-প্রশিক্ষিত প্রাকৃতিক দার্শনিকদের সঙ্গে কারিগর ও হস্তশিল্পীদের ব্যবধান কমে গেল।
বহু প্রাচীন সভ্যতার সম্মিলিত অবদানেই যে এ বিপ্লব ঘটল তাতে সন্দেহ নেই – প্রাচীন গ্রীক সভ্যতা, খ্রিস্টীয় সভ্যতা, ইসলামি সভ্যতা এবং ইসলাম মারফত প্রাচীন বনেদি ভারত ও চীনের সভ্যতা। কিন্তু বিজ্ঞান বিপ্লবের পর নতুন যে-বিজ্ঞান গড়ে উঠল তা প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের পুরোনো যেকোনো ধারা থেকে নিতান্ত আলাদা, যদিও সেইসব ধারা থেকে উপাদান নিয়েই তার উৎপত্তি। গ্রীক-রোমান, ইহুদি-খ্রিস্টীয় ধারা সম্বন্ধেও সেই একই কথা, যদিও এগুলিই হল পাশ্চাত্য সভ্যতার সাক্ষাৎ পূর্বপুরুষ। প্রাচীন সভ্যতাগুলির গণিত-ভিত্তিক ও পর্যাবেক্ষণ-জাত জ্ঞানভান্ডার থেকে কিছু কিছু উপাদান তা গ্রহণ করল বটে, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান প্রাচীন ব্রহ্মাণ্ডকে আর দূরকল্পনাভিত্তিক প্রাচীন যুক্তিশীলতাকে উলটে দিল, গড়ে তুলল ব্রাহ্মণ্ড সম্পর্কে এবং ‘তাহারি মাঝখানে’ মানুষের স্থান বিষয়ক নতুন এক ধারণা। এ বিপ্লব এতই সামগ্রিক যে হিন্দু, খ্রিস্টীয়, ইসলামি, ইহুদি, বৌদ্ধ, তাওবাদী, সর্বপ্রাণবাদী কোনো প্রাক্‌-আধুনিক জ্ঞানতান্ত্রিক ঐতিহ্যর পক্ষেই আধুনিক বিজ্ঞানীদের তোলা প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়া সম্ভব ছিল না। ও কথাটা তোলাই যুক্তিশাস্ত্রের একটা ব্যত্যয়। একথা অবশ্যই ঠিক যে প্রকৃতি তার স্বভাব বদলায়নি, তার সংগঠন, তার ক্রিয়াকর্মর নিয়ন্তা মৌলিক নিয়মগুলি বদলায়নি; কিন্তু আগে যেসব ধারণার বর্গে তাদের বসানো হত, তার পদ্ধতিতান্ত্রিক মাপকাঠিগুলো, অনুসন্ধানের প্রক্রিয়াগুলি সবই মৌলিকভাবে বদলে গেছে। তাই প্রাচীন কালের বাসিন্দা আর আধুনিক বিজ্ঞানীদের বাস কার্যত দুই আলাদা বিশ্বে।
আধুনিক বিজ্ঞানের এই জন্মবৃত্তান্ত স্বীকার করে নিলে, এই ভাবনাটাই সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে পড়ে যে, যেসব প্রশ্নের উদয় হয়েছে সবে গত পাঁচশো বছরে তাদের উত্তর আগে থেকেই প্রাচীনরা জানতেন। বলা বাহুল্য, অভিজ্ঞতালব্ধ কিছু কিছু প্রাচীন জ্ঞানের টুকরো আধুনিক জ্ঞানভাণ্ডারে অবশ্যই যুক্ত হতে পারে। তবে তার শর্ত হল, “বৈজ্ঞানিক” বলে বিবেচিত হতে হলে অভিজ্ঞতালব্ধ যেকোনো দাবিকেই কঠোর পরীক্ষার ছাঁকনি পার হয়ে আসতে হবে, তাদেরও সেসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। উপযোগী ভেষজ উদ্ভিদ, কৃষিকাজের জৈব পদ্ধতি, এগুলি হল সেই ধরনের জ্ঞানের উদাহরণ। কিন্তু তার বাইরে যদি কেউ এরকম দাবি করে যে আধুনিক বিজ্ঞান কেবল প্রাচীনদের জানা জ্ঞানেরই পুনরাবৃত্তি করছে মাত্র, সেটা গালভরা কথা ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রাচীন আর আধুনিক বিজ্ঞানসমূহের মধ্যে ছেদহীন ধারাবাহিকতার ওপর জোর দেওয়াটা অনভিপ্রেত তো বটেই, উপরন্তু একেবারেই নিষ্ফল। যা কিছু জানার আছে সেসবই আমরা আগে থেকেই জানতাম, যা কিছু আমাদের জানা ছিল সেসবই আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে, কোনো কিছুই প্রত্যাখ্যাত হয়নি – এই প্রত্যয়টাই আমাদের সত্যিকারের অনুসন্ধান করার মনোভাব গড়ে তোলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“আমি জানি না” –এই মহাবাক্যই তো জ্ঞান অর্জনের প্রথম ধাপ। ইয়ুভাল হারারি তাঁর প্রভাবশালী সেপিয়েন্স বইতে এ কথাটা খুব সুন্দর করে বলেছেন –
‘বিজ্ঞান বিপ্লবের বিপ্লবটা জ্ঞানের ক্ষেত্রে ঘটেনি। … ঘটেছিল অজ্ঞতার ক্ষেত্রে। যে-মস্ত আবিষ্কারটা বিজ্ঞান-বিপ্লবকে চালু করে দিল সেটা হল, মানুষ তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর উত্তর জানে না। … আরও সমালোচনাত্মক ভাবে দেখলে, আধুনিক বিজ্ঞান স্বীকার করে যে যাকিছু আমরা জানি সেসবই জ্ঞানের আরও প্রসার ঘটলে ভুল প্রমাণিত হতে পারে। কোনো ধ্যানধারণা, কোনো ভাবনা বা তত্ত্বই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়’।
এই কথাটা মেনে নেওয়ার ফলেই ইউরোপে আধুনিক যুগের প্রথম পর্বে, অর্থাৎ ষোলো থেকে আঠেরো শতকের মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ সম্ভব হয়ে উঠেছিল।
এই প্রক্রিয়াটা মোটেই মসৃণ ছিল না। চার্চ আর আরিস্টটল-পন্থী অধ্যাপকদের তরফ থেকে প্রতিরোধ এসেছিল। তাঁরাই তো মধ্যযুগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চালাতেন। তবু ঘটনাক্রমে একটা চেতনা জেগে উঠল যে গ্রীক দার্শনিকদের আর বাইবেলের সিদ্ধান্তগুলো ভুল, কারণ তারা প্রণালীবদ্ধভাবে এবং উত্তরোত্তর নিখুঁতভাবে পরিচালিত পরীক্ষানিরীক্ষা মারফত সংগৃহীত সাক্ষ্যগুলিকে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। গ্রীকদের ভূকেন্দ্রিক ব্রহ্মাণ্ড, অসুখের রস-ভিত্তিক তত্ত্ব, পতনশীল বস্তু সম্পর্কে আরিস্টটলের তত্ত্ব এবং বাইবেল কথিত সাত দিনে সৃষ্টির তত্ত্ব, মহাপ্লাবন তত্ত্ব, সবই ভুল বলে প্রমাণিত হল। অথচ ওই সময়কার কোপার্নিকাস, ভেসালিয়াস, নিউটন, এমনকী পরের পর্বের ডারউইন প্রমুখ পথপ্রদর্শকরা সকলেই ছিলেন ভক্ত খ্রিস্টান। এঁরা প্রত্যেকেই কিছু পরিমাণে গ্রীক দর্শন থেকে আর বাইবেল থেকে আহরিত ঐতিহ্যসম্মত মধ্যযুগীয় বিশ্ববীক্ষার আওতার মধ্য থেকেই কাজ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও তাঁরা এমন একটা প্রক্রিয়া চালু করে দিতে সমর্থ হলেন যা শেষ পর্যন্ত উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ওই কাঠামোটাকেই উলটে ফেলে দিল।
তার চেয়েও বড়ো কথা হল, ধর্মের বাধা সত্ত্বেও বিজ্ঞান-বিপ্লবীরা কিন্তু ঐতিহ্যের প্রবল চাপের মুখে নিজেদের তত্ত্ব আর পদ্ধতিগুলোকে আরিস্টটল আর বাইবেল-নির্ধারিত তত্ত্ব আর পদ্ধতির সঙ্গে “সামঞ্জস্যপূর্ণ” করে তোলার চেষ্টা করলেন না। কোপার্নিকাসের সূর্য-কেন্দ্রিক ব্রহ্মাণ্ডের তত্ত্বকে টলেমির প্রাচীন ভূকেন্দ্রিক ব্রহ্মাণ্ড তত্ত্বের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হল না। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বকেও বাঁকিয়েচুরিয়ে বাইবেলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রূপ দেওয়া হল না। ধর্মীয় মহল প্রথম দিকে যতই হম্বিতম্বি করুক, অবশেষে ঐতিহ্যবাহী শিবিরকেই সাক্ষ্যপ্রমাণের শক্তির কাছে নতি স্বীকার করতে হয়েছিল। আদিযুগের প্রকৃতি বিষয়ক বিজ্ঞানীদের আধিদৈবিক দূরকল্পনাগুলিকে শেষ পর্যন্ত হার স্বীকার করতে হল নিখুঁত মাপজোক আর পারিমাণিক রূপদানের পরীক্ষাভিত্তিক পদ্ধতির কাছে।
কিন্তু ভারতে তা হয়নি। চৈতন্য বা আত্মাই আদি – এই দৃষ্টিভঙ্গির মূলে আঘাত করতে চাইল যেসব ভাবনা, ঐতিহ্যপন্থীদের শক্তি যেভাবেই হোক তাদের কবজা করে নিতে কিংবা পোষ মানাতে সক্ষম হল। ভারতে বিজ্ঞানের ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত প্রচুর যেখানে উন্নত মনের মানুষরা নিজেরাই নিজেদের ভাবনাকে খর্ব করেছেন। যেমন ধরা যাক, ‘সিদ্ধান্তে’ যখনই পুরাণের সঙ্গে গাণিতিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে বলে মনে হয়েছে সেখানেই আমাদের অনেক প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিজ্ঞানী পুরাণকেই শিরোধার্য করে ‘সিদ্ধান্ত’কে খাটো করেছেন। সপ্তম শতকে ব্রহ্মগুপ্ত এর দুঃখজনক উদাহরণ। তিনি আর্যভটর গ্রহণ-তত্ত্বর বিরোধিতা করেছিলেন রাহু আর কেতুর কথা বলে। বিরোধী যুক্তিতর্কর সম্মুখীন হলে আমাদের বিদ্বানরা নিজেরা যেটাকে সত্য বলে জেনেছেন, যার সপক্ষে রয়েছে উন্নততর সাক্ষ্যপ্রমাণ, তার হয়ে রুখে দাঁড়াতেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা বেদ আর উপনিষদের চিরন্তন সত্যগুলির সামনে নতজানু হতেন। আচার অনুষ্ঠানের নিয়মকানুন, সামাজিক অভ্যাস আর বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে রক্ষণশীলতা আর মানিয়ে চলার মনোভাব এত গভীরে শক্তিশালী শিকড় গেড়েছিল যে আমাদের বিদ্বান মানুষদের কখনো গ্যালিলিওর মতো ধর্ম-আদালতে ডেকে পাঠানোর দরকার হয়নি – তাঁরা নিজে থেকেই নিজেদের জানা সত্যকে অস্বীকার করতে এগিয়ে এসেছিলেন।

(উৎস: Meera Nanda, Science in Saffron. বাংলা অনুবাদ: আশীষ লাহিড়ী)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 + nineteen =