বার্ধক্যের রহস্য ও শীতঘুম

বার্ধক্যের রহস্য ও শীতঘুম

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২১ মার্চ, ২০২৫

বার্ধক্য বয়স বাড়ার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা প্রতিটি মানুষের জীবনেই ঘটে। জন্মের পর থেকেই আমাদের শরীর বৃদ্ধি পায়, মেরামত হয়, আবার ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে ক্ষয় হতে শুরু করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্বকে বলিরেখা পড়ে, চামড়া ঝুলে যায়, চুল সাদা হতে থাকে, এগুলো সবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু বার্ধক্যের আসল পরিবর্তন নিহিত থাকে শরীরের ভেতরে ছোট ছোট কোষের মধ্যে । সময়ের সাথে সাথে কোষগুলো দুর্বল হয় ও ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে আর এটাই আমাদের বৃদ্ধ হওয়ার কারণ।কিন্তু কিছু কিছু প্রাণী এমনভাবে বাঁচতে পারে, যাতে তাদের বয়স বাড়ার গতি কমে যায়। যেমন মাদাগাস্কার দ্বীপের লেমুর নামক একজাতীয় ছুঁচলো মুখওয়ালা নিশাচর বানর। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, যখন এই প্রাণীটি শীতঘুমে যায়, তখন এর শরীরের কোষগুলোর বয়স বাড়ার গতি ধীর হয়ে যায়। এই গবেষণাটি করেছেন ডিউক বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা।আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে ক্রোমোসোম থাকে, যার প্রান্তদেশে ছোট ঢাকনার মতো টেলোমিয়ার থাকে। এটি আমাদের জিনসম্পর্কিত তথ্যকে রক্ষা করে – ঠিক যেমন জুতার ফিতার শেষে থাকা প্লাস্টিকের ঢাকনাটা ফিতেকে ছিঁড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচায়।কিন্তু কোষ বিভাজনের সময় এই টেলোমিয়ার একটু একটু করে ছোট হতে থাকে। অতিরিক্ত চাপ, কম ঘুম ও অলস জীবনযাপনে এই প্রক্রিয়া আরও দ্রুত হয়ে কোষ দুর্বল হয়ে পড়ে।কিন্তু মাদাগাস্কারের বামন লেমুর (ডোয়ার্ফ লেমুর) এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, শীতঘুমে যাওয়ার সময় এদের কোষ নতুন শক্তি পায় ও বয়স বাড়ার গতি কমে যায়।শীত এলে বামন লেমুররা গাছের ফোকরে বা মাটির নিচের গর্তে লুকিয়ে থাকে। তারা সেখানে টানা সাত মাস ঘুমের মতো অবস্থায় থাকে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এটি খাদ্যের অভাবের সময় বেঁচে থাকার একটি উপায়। এই সময়ে এভাবে তারা না খেয়ে বেঁচে থাকে। এইসময় তাদের হৃদস্পন্দন প্রতি মিনিটে ২০০ থেকে মাত্র ৮-এ নেমে যায়, শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাসও খুব ধীর হয়ে যায়।এই পরিবর্তনগুলো বুঝতে, ডিউক লেমুর সেন্টারের গবেষকরা ১৫টি বামন লেমুরকে ঘুমের আগে, ঘুমের সময় এবং ঘুমের পরে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাঁরা এদের গালের কোষ পরীক্ষা করে টেলোমিয়ারের পরিবর্তন লক্ষ্য করেন।প্রাকৃতিক পরিবেশের মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে তাঁরা ধীরে ধীরে তাপমাত্রা কমান এবং কৃত্রিম গর্ত তৈরি করেন। এরমধ্যে কিছু লেমুরকে মাঝে মাঝে খাবার দেওয়া হয়, আর অন্যদের শুধু শরীরের জমা চর্বি ব্যবহার করে বেঁচে থাকতে হয়, ঠিক যেমন তারা বন্য জীবনে বেঁচে থাকে ।গবেষক গ্রিন বলেন প্রথমে মনে হয়েছিল, হয়তো উপাত্তে কোনো ভুল হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা যায়, শীতঘুমের সময় লেমুরদের টেলোমিয়ার ছোট হওয়ার বদলে বরং বড় হচ্ছিল। ইউসিএসএফএর বিজ্ঞানী ডানা স্মিথ নোবেলজয়ী গবেষক এলিজাবেথ ব্ল্যাকবার্নের সঙ্গে মিলে এই ফলাফলটি নিশ্চিত করেছেন।টানা গভীর ঘুমে থাকা লেমুরদের টেলোমিয়ার সবচেয়ে বেশি বড় হয়েছিল। কিন্তু যারা মাঝে মাঝে জেগে খাবার খেয়েছে, তাদের মধ্যে তেমন পরিবর্তন দেখা যায়নি। তবে লেমুরদের টেলোমিয়ার বড় হলেও তা স্থায়ী ছিল না। শীতঘুম শেষ হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যেই তা আবার আগের মতো ছোট হয়ে যায়।গবেষকদের ধারণা, টেলোমিয়ার বড় হওয়াটা শরীরকে ভেতর থেকে ঠিক করতে সাহায্য করে।কারণ শীতঘুমের পর শরীর ধীরে ধীরে গরম হয়ে ওঠে ।গবেষক গ্রিন বলছেন এটা অনেকটা ঠান্ডায় অনেকক্ষণ পড়ে থাকা গাড়ি হঠাৎ চালু করার মতো। লেমুরদের শরীর শীতঘুম থেকে জেগে ওঠার সময় হঠাৎ বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। চরম পরিবেশে থাকা মানুষদের শরীরেও এমন ঘটনা দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ আন্তর্জাতিক মহাকাশকেন্দ্রে এক বছর কাটানো নভোচারীরা এবং কয়েক মাস ধরে জলের নিচে বসবাসকারী ডুবুরিদের শরীরেও টেলোমিয়ার বড় হতে দেখা গেছে।লেমুরদের টেলোমিয়ার বড় হলে তাদের কোষ বেশি দিন ভালোভাবে কাজ করতে পারে। এ কারণেই তারা দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।বামন লেমুরেরা প্রায় ৩০ বছর বাঁচে, যা গ্যালাগো নামের একই আকারের আরেকটি প্রাণীর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।গ্যালাগো – রা শীতঘুমে যায় না, তাই এদের আয়ুও কম।বিজ্ঞানীরা এখনো ঠিক বুঝতে পারেননি, বামন লেমুররা কীভাবে তাদের কোষকে নতুন শক্তি দেয়। এই রহস্যের সমাধান হলে মানুষের বয়সজনিত রোগের নতুন চিকিৎসার দিগন্ত খুলে যেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে একটা সমস্যা আছে। টেলোমিয়ার বড় হলে ভালো ঠিকই, কিন্তু অতিরিক্ত বড় হলে বিপদও হতে পারে।যদি টেলোমিয়ার খুব বেশি বড় হয়, তাহলে কোষ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বিভাজিত হয়ে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই বিজ্ঞানীদের এমন উপায় খুঁজতে হবে, যাতে কোনরকম ক্ষতি ছাড়া শরীর উপকার পায়।এই গবেষণাটি ডিউক লেমুর সেন্টারের সহায়তায় করা হয়েছে।বিজ্ঞানীরা এই লেমুরদের ভালোভাবে বুঝতে পারলে হয়তো মানুষের বার্ধক্য ধীর করার নতুন উপায় খুঁজে বের করা যেতে পারে, যাতে মানুষ আরও সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন পেতে পারে।
বায়োলজি লেটার্স পত্রিকায় এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × five =