মাদক মিশরী নীলকমল

মাদক মিশরী নীলকমল

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৮ মার্চ, ২০২৫

মিশরীয় রাজা তুতান খামুনের মমির উপর শোভা পায় মনোমুগ্ধকর এক ফুল- নীলকমল। আকর্ষণীয় এই জলকুমুদ, দীর্ঘকাল ধরে পুরাতত্ত্ববিদ এবং ইতিহাসবিদদের মোহিত করে আসছে। নীলকমলের চিত্র বহু প্রাচীন লিপি এবং মন্দিরের চিত্রকলায় দেখা যায় । বহু দশক ধরে, বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন যে এই ফুলে শক্তিশালী মাদকগুণ রয়েছে। যে সব উৎসবে বিশেষত ধর্মীয় অনুষ্ঠান- হাথোরিক উৎসবে, মাদক যুক্ত ছিল সেখানে এটির ব্যবহার হতো। বর্তমানে, নীলকমল উদ্ভিদ অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে রমরম করে। শুধু তাই নয়, শান্তি থেকে উচ্চ সচেতনতা সবরকমের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এই গাছ। তবে ইউ সি বার্কলের মানবতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র লিয়াম মকইভয় মনে করেন, এসব আধুনিক পণ্য প্রাচীন নীল কমলের সাথে কোন তুলনাতেই আসে না। আসলে মকইভয়, সত্যিকারের মিশরীয় নীলকমলের কাহিনী অনুসন্ধানে বছরের পর বছর কাজ করছেন। মিশরতত্ত্বে মাইনর ডিগ্রি এবং ইউ সি বার্কলের সাইকডেলিক বিজ্ঞান কেন্দ্রের সাহায্য নিয়ে, তিনি প্রাচীন পাঠ্য-গ্রন্থগুলি পড়েছেন। মকইভয়ের তদন্ত বলছে, প্রাচীন মিশরে সমাদৃত এই উদ্ভিদ আর বর্তমানে অনলাইন বাজারে বিক্রীত জলকুমুদ এক নয়। এমনকি এর প্রজাতি এবং সম্ভাব্য প্রভাবগুলি সম্পর্কে ব্যাপকভাবে ভুল বোঝানো হচ্ছে। মকইভয়ের এই যাত্রা অপ্রত্যাশিতভাবে শুরু হয় তার হাই স্কুল জীবনে। তখন তিনি একটি পুরানো বি বি সি তথ্যচিত্র ‘পবিত্র মাদক’ দেখতে শুরু করেন। সেই তথ্যচিত্রে গবেষকরা অংশগ্রহণকারীদের নীলকমল পাপড়ি মিশ্রিত মদ পান করান। অংশগ্রহণকারীরা আদৌ মত্ত অবস্থায় আছেন কিনা তা পর্যবেক্ষণ করেন। সেই দৃশ্য তার মনে গভীর ছাপ রেখে যায়। তিনি মুগ্ধ হয়ে পড়েন। “আমি চেয়েছিলাম এই উদ্ভিদ এবং আমার খোঁজ তার নিজের গল্প বলুক এবং এমন আলোচনায় অবদান রাখুক, যেখানে বিজ্ঞানের জালিয়াতি করে কিছু মানুষ অসৎ উপার্জন করছে”। বার্কলে আসার পর মকইভয় আরো গভীরে পড়াশোনা শুরু করেন। পিয়েবা এ. হার্স্ট মানবতত্ত্ব জাদুঘরের কোর্সওয়ার্ক এবং কাজের মাধ্যমে, তিনি মিশরীচিত্রলিপি বা হায়েরোগ্লিফ শেখেন এবং অনুরূপ পাপড়ির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সত্যিকারের মিশরীয় নীলকমলকে চিনতে শেখেন। যত বেশি পড়াশোনা করেন, ততই তার সন্দেহ হয় যে অনলাইনে বহুল বিক্রিত “নীল কমল” আসল নয়! অনেক পণ্যই আজকাল শান্ত মেজাজ অথবা বিপরীতে, কামোত্তেজক হিসাবে বিপণন করা হয়। এগুলি চা, ভ্যাপ বা গন্ধসার তেলে ব্যবহৃত হয়। বিক্রেতারা দাবি করে, আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি থেকে শুরু করে ঘুমের উন্নতি সবই এর দ্বারা সম্ভব ! সত্যিকার নমুনা খুঁজে বের করতে, মকইভয়ের প্রয়োজন ছিল একটি নির্ভেজাল নমুনা। বন্য জনসমষ্টি এখন বিরল – বাঁধ নির্মাণ ও আবাসস্থলের হ্রাস নীলকমলের প্রজাতিটিকে বিলুপ্তির প্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। ইন্টারনেট ঘেঁটে এরিজোনার একজন ব্যবহারকারীর সাথে তার যোগাযোগ হয়। সেই ব্যক্তি দাবি করেন, তার কাছে ‘আসল নীলকমল’ বেড়ে উঠছে। সেই অচেনা ব্যক্তি একটি সজীব উদ্ভিদ পাঠাতে রাজি হন, যা বার্কলের উদ্ভিদবিদরা ‘আসল’ বলেই নিশ্চিত করেন। উদ্ভিদটি এখন ইউ সি বার্কলের বাগানে, ভার্জিনিয়া হালদান ট্রপিক্যাল হাউসে , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রহে রয়েছে। এটিই একমাত্র ‘জ্ঞাত সজীব মিশরীয় নীলকমল’। অপরদিকে মকইভয়, নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সাইট থেকে পাপড়ি এনে ওটির সঙ্গে তুলনা করেন। বার্কলের রসায়ন প্রফেসর ইভান উইলিয়ামস এবং বৈজ্ঞানিক অ্যান্টনি ইয়াভারোনের সাথে সহযোগিতা করে, তিনি মাস স্পেক্ট্রোমেট্রি ব্যবহার করে উভয় নমুনা বিশ্লেষণ করেন। আসল ফুলে নুসিফেরিন অ্যালকালয়েডের পরিমাণ অনেক বেশি ছিল, যা এর মাদক প্রভাবের জন্য দায়ী। অন্যদিকে অনলাইনের নমুনাটি সম্ভবত একটি সাধারণ অ-মাদক সাধারণ জলকুমুদ। প্রাচীন মিশরীয়রা নাকি সরাসরি নীলকমলকে মদে ভিজিয়ে দিত, মাদকের নেশা কমাতে। কিন্তু মকইভয়ের রাসায়নিক বিশ্লেষণ বলছে এটা সম্ভবত সত্য নয়। যদিও সুবিশুদ্ধ নুসিফেরিন অ্যালকোহলে গলে যায়, তবে মোমের মতো পাপড়িগুলি এটিকে সহজে গলতে দেয় না। বরং, জলপাই তেলের মতো একটি চর্বি সদৃশ পদার্থ যা কদাচিত তেল তৈরির আগে যৌগটি ব্যবহৃত হত, সেটি পরে মদে মেশানো হত। এই সংশোধিত ধারণা প্রাচীন মিশরীয় আনুষ্ঠানিক অনুশীলন সম্পর্কে বহু শতাব্দীর ধারণাগুলিকে নতুন করে দেখতে সাহায্য করে। মকইভয় পরবর্তীতে, হার্স্ট জাদুঘরে সংরক্ষিত ৩০০০ বছরের একটি মিশরীয় কাচের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে, তেল সম্পর্কিত তার তত্ত্বকে সমর্থন করার জন্য কমলের আণুবিক অবশেষ পর্যন্ত যেতে চান। উইলিয়ামস এবং পিএইচডি কর্মী বীনা আবাধানীর সাথে, তিনি তরল ক্রোমাটোগ্রাফি ব্যবহার করে ফুলের রাসায়নিক গঠন আরো গভীরভাবে আ য় ত্ত করার পরিকল্পনা করছেন।এই উন্নত পদ্ধতি তাদের পৃথক যৌগগুলিকে আলাদা করতে এবং সত্যিকারের নীল কমলকে অনন্য করে তোলার কারণগুলি সম্পর্কে পরিষ্কার করে বুঝতে সাহায্য করবে। এই কাজের মধ্যে, তিনি ইতিমধ্যে একটি ফুলের কাহিনী পুনর্নিমাণ করেছেন, যাকে আগে পৌরাণিক বা আধ্যাত্মিক বলে মানা হত। তাঁর প্রকল্পটি শুধু যে বর্তমানের কমল-মিশ্রিত স্বাস্থ্য পণ্যগুলির প্রকৃত তথ্য ও কল্পনার মধ্যে পার্থক্য করেদেয় তাই নয়, বরং একটি প্রাচীন সভ্যতার জীবন্ত অভিজ্ঞতার জানালা খুলে দেয়। উপসংহারে তিনি জানান, “এটি একটি দুর্লভ উদাহরণ – কীভাবে প্রাচীন যাদু ও আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের চারপাশে বিদ্যমান। প্রকৃতিকে গভীরভাবে বুঝতে একসাথে দুটিই কাজে আসতে পারে”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twenty − 15 =