মস্তিষ্কে স্মৃতি-ফটকের দারোয়ান

মস্তিষ্কে স্মৃতি-ফটকের দারোয়ান

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৯ এপ্রিল, ২০২৫

মস্তিষ্ক কী করে নতুন নতুন তথ্য আর স্মৃতি সঞ্চয় করে? কতকগুলো ভাবনা বিশেষ বিশেষ নিউরনের মধ্যে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটায়, কতকগুলো আবার মস্তিষ্ককোষের মধ্যে কাঠামোগত পরিবর্তনের উপর নির্ভর করে। ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজের ডঃ টমাস রায়ানের গবেষণা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, স্মৃতি গঠনের প্রক্রিয়াটি দাঁড়িয়ে থাকে ‘এনগ্রাম কোষ’ নামে অভিহিত কতকগুলি কোষ-গোষ্ঠীর পারস্পরিক সংযোগের উপর। এনগ্রাম কোষই আলাদা আলাদা অভিজ্ঞতা ধারণ ও সঞ্চয় করে বলে মনে করা হয়। গবেষকদের ধারণা, প্রতিটি অভিজ্ঞতা মস্তিষ্ককোষে এক ধরণের সক্রিয়তা সঞ্চার করে, এবং সেটিকে পরে বোতাম টিপে চালু করে দেওয়া যায়। এই প্রক্রিয়াটা কী করে চলে তা দেখবার জন্য স্নায়ুবিজ্ঞানীরা দুটি আলাদা স্মৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুটি এনগ্রাম কোষের গোষ্ঠীকে অনুসরণ করেন। তাঁরা দেখেন, একটি গোষ্ঠীকে সক্রিয় করে তুললে অনেক সময় অন্য গোষ্ঠীটিও সক্রিয় হয়ে ওঠে। যেন দুটি গোষ্ঠী সংযুক্ত হয়ে পড়েছে। আগে মনে করা হত, একখানা নিউরনই বুঝি গোটা স্মৃতির ধারক। বর্তমান গবেষণা কিন্তু উলটো কথা বলছে: কোষগুলো নিজেদের মধ্যে যে-সংযোগ গড়ে তোলে তারই মধ্যে সম্ভবত স্মৃতির অধিষ্ঠান। সেইসব সংযোগ সময়ের সঙ্গে বদলে বদলে যায়। কাঠামোগুলো এইভাবে বদলে যায় বলেই আমরা পুরোনো অভিজ্ঞতা না-হারিয়েই নতুন তথ্যের মোকাবিলা করতে পারি। সহ-গবেষক ক্লারা ওর্টেগা-ডি-সান-লুইস জানিয়েছেন, ‘এনগ্রাম কোষগুলি বিশেষ বিশেষ অভিজ্ঞতার দ্বারা সক্রিয় হয়ে উঠে নিজেদের বদলে ফেলে, যাতে করে মস্তিষ্কের মধ্যে তথ্যকে অন্তর্গ্রথিত করে নিয়ে ধরে রাখতে পারে’। একই ধরনের কিংবা সংশ্লিষ্ট স্মৃতিগুলি কীভাবে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলে জমা থাকে তার ধারা অনুসরণ করেছেন তাঁরা। যেসব নিউরন একটা বিশেষ ঘটনায় সক্রিয় হয়ে ওঠে, তাদের গায়ে জিনঘটিত প্রকৌশলে ছাপ দিয়ে দেন তাঁরা। অতঃপর সেই একই নিউরনগুলি সংশ্লিষ্ট বলে অনুভূত দ্বিতীয় একটি ঘটনায় কীভাবে সাড়া দেয় তা পর্যবেক্ষণ করেন। ছাপ-মারা এইসব নিউরন কত ভালো করে পুরোনো অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত কোষগুলির সঙ্গে নতুন স্বতন্ত্র কোষগুলোর বন্ধন তৈরি করতে পারছে, সেটা পরিমাপ করেন তাঁরা। এ থেকে একটা বড়ো সূত্র বেরিয়ে আসে। আলোক-জিনতত্ত্ব নামে একটা পদ্ধতি আছে যাতে কোষগুলোকে আলোর সাহায্যে জ্বালানো বা নেভানো যায়। এই পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে তাঁরা পরীক্ষা করে দেখেন, নব-গঠিত বন্ধনগুলিকে আটকে দিলে স্মৃতি ব্যাহত হয় কিনা। দেখা গেল, পিএসডি-৯৫ নামে একটি বিশেষ প্রোটিন যেন এইসব এনগ্রাম কোষের দারোয়ান। স্নায়ুকোষের সংযোগস্থলে বসে এই প্রোটিন-দারোয়ান নোঙর-গ্রাহক অণুগুলিকে সাহায্য করে চলে। নির্দিষ্ট একটি স্মৃতি-সংবলিত নিউরনগুলির মধ্যে এই প্রোটিনের পরিমাণ কমিয়ে দিলে এই সংযোগগুলি অন্যভাবে ক্রিয়া করে। কোনো কোনো পরিস্থিতিতে স্মৃতিকে ক্ষীণ করে তোলার চেষ্টা করলেও স্মৃতি যেন টিকে থাকে বলে মনে হয়। এইভাবে টিকে থাকা থেকে জানা যায় যেসব স্মৃতি ধূসর হয়ে যাবে আমরা ধরে নিই, আমাদের মস্তিষ্ক কীভাবে সেইসব স্মৃতিকে ধরে রাখে। শুধু তাই নয়, ওই প্রোটিন সঞ্চিত কিংবা ব্যাহত হলে কেন স্বাভাবিক শিক্ষণপ্রক্রিয়া বিপথগামী হয় তারও ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এই গবেষণার ভিত্তিতে গবেষকরা এখন একক কোষের বদলে অনেকগুলি কোষ মিলে কীভাবে আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা-গ্রাহী জালিকা তৈরি করে তার ওপর মনোনিবেশ করছেন। অত্যাধুনিক জিন-ছাপ মারার প্রকৌশল ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা এখন শনাক্ত করতে পারছেন, কোথায় নতুন সংযোগ তৈরি হচ্ছে। সেইসব সংযোগগুলি পরে স্মৃতি জাগিয়ে তোলার জন্য অপরিহার্য কিনা তাও শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twenty − 6 =