সিংহের কামড় সহ যোদ্ধার কঙ্কাল উদ্ধার

সিংহের কামড় সহ যোদ্ধার কঙ্কাল উদ্ধার

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৫ এপ্রিল, ২০২৫

ইয়র্কের একটি রোমান কবরস্থানে আবিষ্কৃত কঙ্কালে, সিংহের কামড়ের চিহ্ন পাওয়া গেছে। অনুমান করা যায়, এটি সেই সময়ের মানুষ এবং সিংহের মধ্যে রোমান যুদ্ধবিনোদনের প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ। বিশ্বের সবচেয়ে সংরক্ষিত রোমান যুদ্ধের কবরস্থানগুলির মধ্যে একটি হল রিফিল্ড টেরেস। সেখান থেকে কংকালটি খনন এবং পরীক্ষা করা হয়। গবেষকরা ২০১০ সালে ৮২টি সুগঠিত তরুণ পুরুষ কঙ্কালের প্রত্নতাত্ত্বিক পরীক্ষার কথা ঘোষণা করেছিলেন। কঙ্কালগুলি বিশ্বের বিভিন্ন রোমান প্রদেশ থেকে এসেছে। সমাধিস্থলে অস্বাভাবিক অন্তেষ্টিক্রিয়ার প্রমাণ মেলে। এই প্রমাণগুলি দেখে বোঝা যায়, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এইসব ব্যক্তি বিশেষভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। এবং তারা সহিংসতার সাথে লড়াই করে একে অপরকে আঘাত করেছেন। ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অস্টিও আর্কিওলজির প্রভাষক এবং পরিচালক ম্যালিন হলোস্ট দেহাবশেষগুলি খনন বিশ্লেষণে নেতৃত্ব দেন। তিনি জানান, “কামড়ের চিহ্নগুলি সম্ভবত একটি সিংহের থেকে এসেছে। যা নিশ্চিত করে, কবরস্থানে সমাহিত কঙ্কালগুলি সৈন্য বা দাস নয়, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বা পেশাদার যোদ্ধাদের ছিল। এরাই ‘গ্লাডিয়েটর’ নামে পরিচিত। রোমান দুনিয়াতে, এই যুদ্ধ বিনোদনে এক দিকে থাকতো বিরাট কোন মাংসাশী প্রাণী, অপরদিকে যোদ্ধা। ২০০৪ সালের শুরুর দিকে, ইয়র্ক থেকে ট্যাটকাস্টার যাবার সময়, রোমান রাস্তার ধারে ১৮০০ বছর পুরনো কবরস্থান থেকে প্রথম এই কঙ্কালটি উদ্ধার করা হয়। আয়ারল্যান্ডের মেনুথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টিম টমসন বলেন,” বছরের পর বছর রোমান যুদ্ধবিনোদনকারীদের বিশেষত প্রাণী ও মানুষের মধ্যে যুদ্ধের দৃশ্য প্রামান্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ এবং শৈল্পিক চিত্রের উপরে নির্ভর করে আছে। এই আবিষ্কারটি, প্রথম প্রত্যক্ষ বাস্তব প্রমাণ যে সেই সময় এই ধরনের ঘটনা সত্যিই ঘটত। এটি এই অঞ্চলে, রোমান বিনোদন সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে নতুন একটি রূপ দান করল”। ২৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সী এই পুরুষের কঙ্কালটি আরো দুজনের সাথে এক কবরেই সমাহিত করা হয়। ঘোড়ার হাড় দিয়ে এটিকে ঢেকে রাখা হয়েছিল। জীবদ্দশায় তার মেরুদন্ডে কিছু সমস্যা ছিল বলে মনে হয়। সম্ভবত এটি, তার পিঠে অতিরিক্ত বোঝা চাপানোর কারণ কিংবা ফুসফুস এবং উরুর প্রদাহ বা শৈশবে তার অপুষ্টির লক্ষণ হতে পারে। যা পরে সেরে উঠছিল। সিংহের কামড়ের ক্ষতটি, চিড়িয়াখানার একটি সিংহের কামড়ের নমুনার সাথে তুলনা করে নিশ্চিত করা গেছে। এই কামড়টি সেরে না ওঠায় সম্ভবত এটিই তার মৃত্যুর কারণ ছিল। বিশ্বাস করা হচ্ছে, মৃত্যুর পরে এই ব্যক্তির শিরচ্ছেদ করা হয়। যা রোমান আমলে কিছু ব্যক্তির জন্য একটি রীতি বলে মনে করা হতো। যদিও এক্ষেত্রে তার মৃত্যুর প্রধান কারণ অস্পষ্ট। কঙ্কালের বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায়, এটি একজন স্বেচ্ছাসেবক বা দাসদের দ্বারা পরিচালিত উন্নতমানের যুদ্ধ বিনোদকের কঙ্কাল। ম্যালিন বলেন, “এটি একটি রোমাঞচকর আবিষ্কার, কারণ আমরা এখন এই যুদ্ধ বিনোদনকারীর জীবন কেমন ছিল, তার একটি চিত্র তৈরি করতে শুরু করেছি। ইয়ার্ক এর মতো শহরের আখড়াগুলিতে সিংহের মতন বড় বিড়াল প্রজাতি বা অন্যান্য বিদেশী প্রাণীর উপস্থিতি, তার সাথে সাথে নানা হুমকি থেকে এই পশুগুলি নিজেদেরকে কিভাবে রক্ষা করেছিল তা জানার মতন। রোমের কলোসিয়ামে সংঘটিত এই যুদ্ধগুলির একটি মানসিক চিত্র আমাদের মধ্যে থাকলেও, সাম্প্রতিক অনুসন্ধানগুলি দেখায় এইধরনের ক্রীড়াগুলি সত্যিই প্রচলিত ছিল। এমনকি মূল রোমান অঞ্চলগুলির কেন্দ্রের বাইরেও। সম্ভবত রোমান ইয়র্কে, একটি উন্মুক্ত প্রেক্ষাগৃহ বা মুক্তমঞ্চওছিল। যদিও সেটি এখনও আবিষ্কৃত হয়নি”। চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিকেও যুদ্ধ বিনোদনের অনুষ্ঠানগুলি চালু ছিল। যে শহরে সেনাবাহিনী প্রধান বা রাজনীতিবিদরা অনেক সময় ধরে বাস করত সেখানে বিলাসবহুল সামাজিক জীবনযাপনের প্রয়োজন পড়তো। তার মধ্যে এমনও আছেন যিনি ৩০৬ খ্রিস্টাব্দে, নিজেকে ‘সম্রাট’ হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। এই বিস্তৃত সমাধিস্থল দেখে তাই অবাক হওয়ার মতন কিছু নেই। তবে এই স্থানগুলিতে হরিণ বা বন্য শূকর নয়, সিংহের মতন বৃহৎ প্রাণীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা এক আকর্ষণীয় বিষয়। পেশাদার যোদ্ধাদের মালিকরা কখনোই তাদের মৃত্যু চাইতেন না। তারা ছিলেন উচ্চমূল্যের ক্রীড়াবিদ। সব সময় চেষ্টা করা হতো, তাদের ভালো ভাবে বাঁচিয়ে রাখার এবং লড়াইয়ে সক্ষম করে রাখার। কিন্তু একান্তই তাদের মৃত্যু হলে, পরকালের সেবার জন্য মৃতদেহের সাথে কিছু উপহারও কবরস্থ করা হতো। যা ডিপফ্রি ফিল্ড টেরেসের কিছু কবরে স্পষ্ট। ওয়ার্ক আর্কিওলজি প্রধান ডেভিড ট্রেনিংস বলেন, “এই সর্বশেষ গবেষণা আমাদের এই বিশেষ ব্যক্তির জীবন এবং মৃত্যুর সম্পর্কে অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টি দেয়। বিশেষ করে রোমান কবরস্থানে সমাহিত কিছু পুরুষের উৎপত্তি, পূর্ববর্তী এবং চলমান জিনোম গবেষণাতেও এটি সাহায্য করবে। আমরা হয়তো জানতে পারবো না, এই ব্যক্তি কেন এরকম যুদ্ধবিনোদনের জন্য লড়াই করতেন। কিন্তু উল্লেখযোগ্য, রোমের কলোসিয়াম থেকে পাওয়া, সম্ভবত বিশ্বেরy ধ্রুপদী ওয়েম্বলি মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠিত এই ধরনের যুদ্ধ বিনোদনের প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 + two =