অলৌকিক ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বে ‘ বিশ্বাসের মনস্তত্ত্ব

অলৌকিক ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বে ‘ বিশ্বাসের মনস্তত্ত্ব

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৮ এপ্রিল, ২০২৫

‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’, কিছু মানুষের কাছে ‘অদ্ভুত’ ঠেকে আবার কিছু মানুষের কাছে ‘এক চরম সত্য’। আমাদের জীবনের বিশেষ অর্থ রয়েছে এবং তাকে খুঁজে বার করা যাপনের মৌলিক চাহিদা। আমাদের অনেক সিদ্ধান্তই সেটা ভালো হোক বা খারাপ হোক, চালিত হয় আমাদের মৌলিক চাহিদা দ্বারা। ‘দ্য কোয়েস্ট ফর সিগনিফিকেন্স’ নামকএকটি বইতে সমাজ- মনোবিজ্ঞানী অ্যারি ক্রুগ্ল্যানস্কি এবং সাংবাদিক ড্যান যাভীর্ভ এই ধারণাটি নিয়ে গভীর অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছেন। এর পিছনে রয়েছে বিস্তৃত মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা। তার মধ্যে নিজের শৈশবের স্মৃতিবিধুর অভিজ্ঞতার কথাও রয়েছে। বইটি মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত গবেষণার ফসল। বিশেষজ্ঞদের যুক্তি, সকল মানুষের মৌলিক চাহিদা প্রায় একই রকম। মানুষ যা কিছু করে বা অর্জন করার চেষ্টা করে কিংবা এড়িয়ে যায় তা মানুষের এক বা একাধিক মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্যই করে থাকে। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলির মধ্যে ‘তাৎপর্য’ এবং ‘গুরুত্ব’ একটি প্রধান চাহিদা। এই চাহিদা প্রায়শই সচেতন চিন্তার আড়ালে চলে যায়। কিন্তু এটিই আমাদের আবেগ, আচরণ এবং বিশ্বাস গঠনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। যখন মানুষ মনে করে তার ‘গুরুত্ব’ কমে যাচ্ছে বা ‘মর্যাদা’ হারিয়ে যাচ্ছে এবং কোনো একটা বিশ্বাস আঁকড়ে ধরলে বা কোনো জায়গায় গেলে, সে সেটিকে আবার খুঁজে পাবে, তখন সে মিথ্যা গল্প বিশ্বাস করতে শুরু করে। এই মিথ্যা গল্পগুলিই, তাকে ‘বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব’ হিসাবে মনে করায়। কখনও কখনও এই বিশ্বাসই তাদের মধ্যে ‘নিয়ন্ত্রণের’ অনুভূতি এনে দেয়। বর্তমানে আর্থিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ এবং বিশ্বজোড়া স্বাস্থ্য সংকট এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে, যেখানে মানুষ নিজেদের অসহায় বা দুর্বল মনে করতে শুরু করেছে। তবে কেবল ‘অনিশ্চয়তা’র হাত ধরে ব্যক্তিগত সমস্যা সৃষ্টি হয়নি। যখন জীবন অস্থির হয়ে ওঠে, তখন মানুষ প্রায়শই সবথেকে খারাপ পরিস্থিতিটা কল্পনা করতে শুরু করে। বাড়িঘর চাকরি বা কৃষ্টি পরিচয় হারানোর ভয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। এই চিন্তাই তখন তাদের মধ্যে একটি শূন্যস্থান তৈরি করে। ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’গুলি তখন সেই শূন্য স্থান পূরণ করতে এগিয়ে আসে- একপ্রকার ‘সহজ উত্তর’ হিসাবে। সারা বিশ্বে, মানুষ তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে আর সেটাই তাদের একটি নির্দিষ্ট আখ্যানের প্রতি বিশ্বাসী করে তোলে। এই আখ্যানগুলি, তাদের মধ্যে তৈরী হওয়া ভয় এবং উদ্বেগকে যেন একপ্রকার স্বীকৃতি দেয়। মানুষের গুরুত্ব কমে যাওয়া বা দূর্দশার কারণকে এই আখ্যানগুলি ঘৃণ্য চক্রান্ত বলে দাগিয়ে দেয়। ‘কোনো সত্তা’কে তারা দোষারোপ করতে শুরু করে। ষড়যন্ত্রতত্ত্বগুলি এবার এই মানুষগুলিকে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তাড়িত করে। এ যেন পুতুলের হাতে সুতো নিয়ে ‘চালনা’ করা! এই গল্পগুলি প্রায়শই একটি অভিন্ন শত্রুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। সেই সূত্র ধরে, মর্যাদা পুনরুদ্ধারের একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায় প্রতিরোধ বা সহিংসতা। এই বর্ণনাগুলির গুরুত্বপূর্ণ আরও একটি দিক হল ‘দুষ্ট চক্রান্তের জন্য দায়ী দল বা দলগুলির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের আহ্বান ‘। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বে’র বিস্তার ঘটেছে। যেখানে বিভিন্ন ধরনের অপরাধীদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে সহিংস মোকাবিলার আহ্বান জানানো হয়। এক্ষেত্রে একটি সুপরিচিত উদাহরণ হল, অলৌকিক সর্বনাশ তত্ত্বের গুরু ডেভিড আইক প্রচারিত বাণী। তিনি দাবি করছেন “মানুষের ছদ্মবেশে একটি আন্ত: মাত্রিক সরীসৃপ জাতি গোপনে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। যার মধ্যে বেশ কিছু তাবড় বিশ্বনেতাও রয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আসল প্রশ্ন হল, এই তথ্যগুলি আজকের শ্রোতা- দর্শকদের কাছে এমন কী প্রস্তাব করতে পারছে যাতে আইকের দাবিগুলিকে তারা গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করছে বা অনুপ্রেরণা হিসেবে নিচ্ছে? এক্ষেত্রে,বিশেষজ্ঞরা লিখেছেন, কলঙ্কজনক মর্মান্তিক সত্যের আড়ালে থাকা একজন ব্যক্তি, নিজেকে ‘বিশেষ কিছু’ মনে করতে থাকেন। ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলি মানুষের কাছে মূল্যবান উপাদান। এগুলি তাদের মধ্যে আত্মীয়তার অনুভূতি দেয় এমন কি আশা জোগায়। এগুলি এমন সমস্ত মানুষের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয় হয়ে পরে, যারা নিজেদের সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে ফেলছে বা নিজেকে ‘শক্তিহীন’ বলে মনে করতে শুরু করেছে। মিথ্যা নায়কের গল্প, এক্ষেত্রে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস গঠন করে। বিদ্যুতের গতিতে, সোশ্যাল মিডিয়া দ্বারা প্রচারিত ষড়যন্ত্রের আখ্যান গুলি অপরাধীদের চিহ্নিত করার দাবি জানায়। বইটি কেবলমাত্র ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিশ্বাসী মানুষের সমস্যার রূপরেখা তুলে ধরেনি, ভবিষ্যতেরও পথ দেখিয়েছে। ‘আত্ম সচেতনতা’ ই মূল উপায়। অনেকেই পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে না, তারা কিসের দ্বারা চালিত হচ্ছে! অন্তর্দৃষ্টির অভাব, তাদের কারসাজি বা ক্ষতিকারক সঙ্গের দিকে টেনে নিয়ে যায় এবং ঝুঁকি প্রবণ করে তোলে। মানুষ জানে না তারা যা করছে, সেটা কেন করছে, কী তাদের কর্মের মূল উদ্দেশ্য, কীভাবে তাদের পছন্দ, সিদ্ধান্ত তৈরি হচ্ছে বা পরিচালিত হচ্ছে! এ ক্ষেত্রে ‘বালিতে মাথা গুঁজে রাখার চেয়ে নিজের সম্পর্কে সত্যের মুখোমুখি হওয়া এবং তার মোকাবিলা করা’ অনেক ভালো। ব্যক্তিগত চাহিদাগুলি জানতে পারলে ভালো সিদ্ধান্ত, শক্তিশালী সম্পর্ক তৈরি হয়। নিজের কর্মের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বৃহত্তর অনুভূতি তৈরি হয়। গর্ব, হিংসা, প্রশংসা, লজ্জা এই আবেগগুলির উপর লেখক মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। কোন বিষয়গুলি আপনার কাছে ঠিক কতটা গুরুত্ব বা তাৎপর্য পায়! কেউ তীব্র প্রতিক্রিয়া জানালে, নিজেকে ‘ছোট বা নিচু’ মনে হয়! ঈর্ষা, সহানুভূতি বা প্রশংসা জাগিয়ে তোলে কোন বিষয়গুলি? এ সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা, জীবনকে আরও সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। আপনাকে কোন কোন জিনিসগুলি বিচলিত করে তোলে, তা বোঝা ‘স্ব-সহায়ক পরামর্শ’ এর সাথে সাথে এক ধরনের ‘প্রতিরক্ষা’র কাজ করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × one =