মিলন-গীতি না ভোজের সংকেত? 

মিলন-গীতি না ভোজের সংকেত? 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১ মে, ২০২৫

মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার গ্রীষ্মমন্ডলীয় বনাঞ্চলে, একধরণের বাদুড়, তার শিকার খোঁজার জন্য কেবল শ্রবণ শক্তির উপর নির্ভর করে। ব্যাঙের মিলনের ডাক কেবলমাত্র একাধিক সঙ্গীকে আকর্ষণ করার জন্য হয়ে থাকে। কিন্তু এই বাদুড় সেই ডাকগুলি রাতের খাবারের যোগান- ঘন্টা হিসাবে সনাক্ত করে। স্মিথসোনিয়ান ট্রপিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট ( STRI ) এর বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা যায়, এই বাদুড়রা জন্মগতভাবে এই জ্ঞান নিয়ে জন্মায় না! সময়ের সাথে সাথে তারা এটি রপ্ত করে। শিকারি বাদুড়ের বেঁচে থাকার এই দক্ষতা কীভাবে তাদের অভিজ্ঞতার উপর প্রভাব ফেলে, তার উপর নতুন আলোকপাত করে গবেষণাটি। শিকারীরা প্রায়শই শিকার ধরার জন্য গোপনীয়তা এবং তীক্ষ্ণ ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর করে। ঠোঁটওয়ালা বাদুড় এই বিষয়টিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। পানামা থেকে ব্রাজিল পর্যন্ত, তাদের আবাসস্থলে থাকা ডজনেরও বেশি ভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙ মিলনের ডাক শুনতে থাকে। সম্ভাব্য সঙ্গীদের উদ্দেশে ছাড়া তাদের এই ডাকগুলি, উল্টে বিপদ ডেকে আনে অনেকসময়! বাদুড়রা ব্যাঙের ডাক শোনার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নিশ্চিত ভাবে প্রাণীটিকে ধরে ফেলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে।

তবে এই কৌশলটিও ঝুঁকিমুক্ত নয়। সব ব্যাঙই খাবার হিসেবে ‘ভালো’ নয়। কিছু ব্যাঙ আকারে অনেক বড়। অপরদিকে, অন্যরা এমন বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে যাতে বাদুড়ের ক্ষতি হয়,এমনকি তাদের প্রাণহানির ঝুঁকিও থাকে! তাদের কাছে এই বিপদকে আগে থেকে ছকে নেওয়ার মতন আলাদা কোন পদ্ধতি থাকে না । ঠোঁটের ঝালরযুক্ত বাদুড়রা তাদের মনপসন্দ ব্যাঙ প্রজাতি সনাক্ত করতে পেরেছে, বলা যেতে পারে। তারা অপ্রীতিকর ব্যাঙের ডাক উপেক্ষা করতে পারে। গবেষকরা জানতে চান তরুণ বাদুড়রা কিভাবে এই শ্রবণ নির্ভর শিকার শুরু করে? এটি কি একটি সহজাত প্রবৃত্তি, নাকি একটি শেখা আচরণ? তারা কি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এগুলির বিকাশ ঘটায়? এই গবেষণা অবশেষে একটি উত্তর দিয়েছে। দলটি প্রাপ্তবয়স্ক এবং কিশোর বাদুড়দের নিয়ে, ১৫টি ভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙ ও ব্যাঙের ডাকের উপর তাদের কার্যকলাপ পরীক্ষা করেন। এগুলির মধ্যে ভোজ্য এবং বিষাক্ত উভয় বিকল্পই উপস্থিত ছিল। ফলাফলগুলি একটি আকর্ষণীয় গল্প বলে। প্রাপ্তবয়স্ক বাদুড়গুলি প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করে। তারা সুস্বাদু ব্যাঙের ডাকে আরও জোরালোভাবে সাড়া দেয় এবং বিষাক্ত বা খুব বড় প্রজাতির ব্যাঙদের ডাক উপেক্ষা করে। কিন্তু ছোট বাদুড়গুলি ভিন্নভাবে আচরণ করে। অনুমান, তারা নিরাপদ এবং বিপজ্জনক ডাকের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। গড়ে, ছোট বাদুড়গুলি ব্যাঙের আকার বা বিষাক্ততা নির্বিশেষে সকলের প্রতিই সমান প্রতিক্রিয়া দেখায়। তবে ছোট বাদুড়গুলি পুরোপুরি অজ্ঞ নয়। তাঁরা লক্ষ্য করেন, ছোট বাদুড়রাও ডাকের স্বরের মধ্য দিয়ে বড় ব্যাঙগুলিকে সনাক্ত করতে পারে। প্রাপ্তবয়স্কদের মতো তারাও তাদের এড়িয়ে চলে। কিন্তু যখন বিষাক্ততার কথা আসে,সেক্ষেত্রে তাদের পৃথগীকরণের কোন পন্থা লক্ষ্য করা যায় না। সুতরাং শিকার শনাক্তকরণের কিছু দিক সহজাত হলেও, অন্য দিকগুলি, বিশেষত বিপদের সাথে জড়িত দিকগুলি, সময় এবং শেখার উপরই নির্ভর করে। প্রবীণ গবেষক র‍্যাচেল পেজ বলেন, “আমরা বছরের পর বছর ধরে এই আকর্ষণীয় প্রজাতিটিকে অধ্যয়ন করে আসছি, এবং অনেক দিক থেকে আমরা এর আচরণ খুব ভালোভাবে বুঝতে পারি। কিন্তু এই প্রথম আমরা কিশোর বাদুড় পরীক্ষা করে দেখলাম। এটা দেখে খুবই মজা লাগলো যে, মানুষেরই মতো, ছোট বাদুড়দেরও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সময় এবং অভিজ্ঞতার প্রয়োজন।” মানব বিকাশের সাথে তুলনাটি এক্ষেত্রে আকর্ষণীয়। ঠিক যেমন ছোট বাচ্চারা কোন খাবার এড়িয়ে চলতে হবে তা জেনে জীবন শুরু করে না, তেমনি ছোট বাদুড়দেরও পরীক্ষা চলতে থাকে, তারা ব্যর্থ হয় এবং ধীরে ধীরে মানিয়ে নেয়। তাদের প্রাথমিক ভুলগুলি মারাত্মক হতে পারে তবে তারা পরিণত হওয়ার সাথে সাথে আরও পরিশীলিত আচরণ গঠনের দিকে এগিয়ে যায়, এই অভিজ্ঞতাগুলির উপর ভর করে। শেখার এই ধরণ, অন্য বাদুড়ের ক্ষেত্রে হয় না, বরং তারা অন্যান্য অনেক প্রজাতির প্রক্রিয়াগুলিকেই প্রতিফলিত করে। এই গবেষণা, তরুণ প্রাণীরা কীভাবে তাদের পরিবেশের জটিলতা নির্ণয় করে এবং বেঁচে থাকতে শেখে সে সম্পর্কে নতুন প্রশ্নের জন্ম দেয়। গবেষকরা বাদুড় এবং অন্যান্য ব্যাঙ-খেকোদের প্রাপ্তবয়স্ক এবং কিশোর শিকারীর মধ্যে সরাসরি ‘আড়ি পাতা’ আচরণের তুলনা করেন। অনেক শিকারী, শিকারের জন্য শব্দের উপর নির্ভর করে। সহগবেষক জিমেনা বার্নাল বলেন, “এই গবেষণাটি শ্রবণশক্তির বিকাশ এবং শেখার ক্ষমতার গুরুত্বকে প্রাধান্য দেয়। বাদুড়ের বাইরেও জটিল সংবেদনশীল পরিবেশে চলাচলকারী অন্যান্য শিকারী প্রাণীদের মধ্যেও এটি বিস্তৃত হতে পারে। আমরা আশা করি এটি অন্যান্য বিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করবে যে শিকারী-খাদ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে কীভাবে প্রাথমিক অভিজ্ঞতা এই সিদ্ধান্তগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে।” গবেষণাটি কেবল একটি প্রজাতির বাদুড়ের জীবন সম্পর্কেই অন্তর্দৃষ্টি রাখে না, এটি আচরণ গঠন এবং তার বিকাশের গুরুত্বের উপর জোর দেয়। ঠোঁটওয়ালা বাদুড়, বন্ধু এবং শত্রুর মধ্যে পার্থক্য করার দক্ষতা ছাড়াই জীবন শুরু করে। অভিজ্ঞতা এবং পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে, সময়ের সাথে সাথে, এর প্রতিক্রিয়াগুলি সুনির্দিষ্ট হয়ে ওঠে। প্রতিটি আহ্বান একটি সূত্র হয়ে ওঠে, এবং প্রতিটি পছন্দ বেঁচে থাকার বিষয়। যে পৃথিবীতে শব্দ, প্রতিশ্রুতি এবং বিপদ উভয়ই বয়ে বেড়ায়, সেখানে ঠোঁটওয়ালা বাদুড়টি দেখায় যে প্রকৃতি কীভাবে ক্ষুদ্রতম শিকারীদেরও শোনার, শেখার এবং বেঁচে থাকার সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 + 20 =