ঝাপসা

ঝাপসা

প্রদীপ্ত গুপ্তরায়
অধ্যক্ষ, দমদম মতিঝিল কলেজ, কোলকাতা
Posted on ১ মে, ২০২৫

∆S≥0 সমীকরণের পেছনে কি রহস্য আছে, লুডউইগ বোল্টজম্যান (Ludwig Boltzmann) সেটা খুঁজে দেখতে চাইলেন। এর ফলে যেন মহাবিশ্বের এক গভীর ব্যাকরণে আমাদের ডুব দিলাম। বোল্টজম্যান গ্রাজ (Graz), হাইডেলবার্গ (Heidelberg), বার্লিন (Berlin), ভিয়েনা (Vienna) এবং আবার গ্রাজে কাজ করেছেন। মার্ডি গ্রাসের সময় জন্মেছিলেন বলে তিনি তাঁর অস্থিরতাকে বৈশিষ্ট্য হিসাবে দেখাতে পছন্দ করতেন। তাঁর চরিত্রের অস্থিরতা এতটাই ছিল, যে কখনো তিনি আংশিক রসিকতা করতেন, বিষন্নতা এবং উল্লাসের মধ্যে একটা দোদুল্যমানতা সবসময় থাকত। তাঁর বেঁটে, স্থূলকায়, কালো কোঁকড়ানো চুল এবং তালিবানের মতো দাড়ি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল। তাঁর বান্ধবী আদর করে ‘আমার প্রিয় মিষ্টি গোল্লু’ বলে ডাকতেন। সময়ের দিগ্‌নির্দেশে লুডউইগ একজন ভাগ্যহীন নায়ক। সাডি কার্ণো ভেবেছিলেন, তাপ একধরনের বস্তু বা পরিস্কারভাবে একধরনের তরল। তিনি ভুল বলেছিলেন। তাপ, অণুর আনুবীক্ষনিক বিচলন ছাড়া আর কিছুই না। গরম চা তে অণুরা বেশি উত্তেজিত থাকে। ঠাণ্ডা চা-এ অনুরা অল্প উত্তেজিত থাকে। বরফকে গরম করলে গলে যায়, আর অণুরা আস্তে আস্তে উত্তেজিত হতে থাকে এবং তাদের অন্তরাণবিক আকর্ষন কমতে থাকে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকেও এমন অনেকে ছিলেন যাঁরা অণু ও পরমাণুর ধারনায় বিশ্বাস করতেন না। লুডউইগ তাদের অস্তিত্ব নিয়ে নিশ্চিত হলেন এবং তাঁর বিশ্বাসের পক্ষে লড়াইয়ে নামলেন। পরমাণুর অস্তিত্ব যাঁরা বিশ্বাস করতেন না তাঁদের সাথে বোল্টজম্যানের দীর্ঘ যুক্তিপূর্ণ আলোচনা এখন কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বিখ্যাত তরুণ বিজ্ঞানীরা পরে বলেছেন, ‘আমাদের প্রজন্মের সবাই তো মানসিকভাবে তাঁর সাথেই আছি। ভিয়েনার এক আলোচনাচক্রে, উত্তপ্ত বিতর্কের শেষে একজন প্রথিতযশা পদার্থবিদ তাঁর বিরুদ্ধে বললেন, বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ মৃত কারন বস্তুর তত্ত্বগুলো সময়ের দিকনির্দেশনা মানে না। পদার্থবিদরা এই ধরনের বোকা বোকা কথা বলতে নিরাপদ না। সূর্য অস্ত যাচ্ছে দেখে কোপার্নিকাস, পৃথিবী ঘুরছে দেখতে পেলেন। এক গ্লাস জল দেখে, বোল্টজম্যান বুঝতে পারলেন, অণু ও পরমাণু ইতস্তত চলাচল করছে। মহাকাশচারীরা চাঁদ থেকে পৃথিবীকে যেমন দেখেন, শান্ত, উজ্জ্বল, নীল – ঠিক সেইরকমই একগ্লাস জলকে আমরা দেখি। চাঁদ থেকে পৃথিবীর — উত্তেজনা সমৃদ্ধ জীবন, এর গাছপালা ও পশুপাখি, আশা ও নিরাশা – কোন কিছুই দেখা যায় না। কেবলমাত্র এক শিরাযুক্ত নীল বল। এক গ্লাস জলেও উজ্জ্বল আলোর প্রতিফলনে ওখানকার মতো আলোড়নপূর্ণ জীবন দেখতে পাই যেটা অগণিত অণুর কর্মকান্ডের ফলে তৈরী হয় – পৃথিবীর জীবিত সত্তা থেকে যা অনেকগুন বেশী। এই বিশৃঙ্খলাই সব কিছু নাড়িয়ে দেয়। অণুদের একটা অংশ যদি স্থির থাকে, পারিপার্শ্বিক ইতস্তত চলাচল করা অণুগুলোর প্রভাবে তারাও গতিপ্রাপ্ত হয়। আলোড়ন ছড়িয়ে পড়ে, অণুগুলো সঙ্ঘাত করে এবং পরস্পরকে ধাক্কা দেয়। এইভাবে, ঠান্ডা বস্তু গরম বস্তুর প্রভাবে গরম হয়। গরম বস্তুর অণুগুলো ঠান্ডা বস্তুর অণুগুলোকে উত্তেজিত করে এবং বিশৃঙ্খল অবস্থায় নিয়ে যায়, এবং এইভাবেই তারা গরম হয়। বোল্টজম্যান এটা বুঝতে পেরেছিলেন। অতীত এবং ভবিষ্যতের মধ্যে তফাৎ গতির প্রাথমিক সুত্রে বা প্রকৃতির গভীর ব্যাকরণে থাকে না। এটা একটা স্বাভাবিক বিশৃঙ্খলা থেকে তৈরি হয়, যেটা কম বিশেষত্ব, কম বিশিষ্ট অবস্থার দিকে নিয়ে যায়। একটা চমৎকার অন্তর্দৃষ্টি যেটা ঠিক পথে চালিত করে। কিন্তু এটা কি অতীত এবং ভবিষ্যতের তফাৎ কে স্পষ্ট করে? না করে না। কেবলমাত্র প্রশ্নটা পালটিয়ে দেয়। এখন প্রশ্নগুলো হোলঃ সময়ের দুটো দিকের মধ্যে একটা দিক – যাকে আমরা অতীত বলছি, কেন জিনিসগুলো খুব সুসংহত অবস্থায় থাকে? কেন অতীতে এনট্রপি কম থাকে? আমরা যদি একটা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করি, প্রাথমিকভাবে যার এনট্রপি কম আছে, তার এনট্রপি বেড়ে যাচ্ছে কারন ঘটনার সব কিছুই রদবদল হয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থায় চলে যায়। কিন্তু কেন মহাবিশ্বের যে কোন ঘটনা কম এনট্রপি থেকে শুরু হয়? এখানেই আমরা মূল লক্ষণটা পেয়ে যাই। তাসের প্যাকেটে ছাব্বিশটা তাস লাল আর বাকি ছাব্বিশটা কালো। আমরা বলতে পারি তাসগুলো শৃঙ্খলিত এবং নির্দিষ্ট অবস্থায় আছে। যখন আমরা তাসগুলো শাফল করি, তখন সেগুলো বিশৃঙ্খল অবস্থায় চলে আসে। প্রাথমিক অবস্থাকে আমরা বলতে পারি, কম এনট্রপি যুক্ত অবস্থা। আমরা যদি লাল অথবা কালো রঙের কথা যখন পর্যালোচনা করি, তাসগুলো নির্দিষ্ট অবস্থায় আছে সেটা বলা যেতে পারে। আরেকটা নির্দিষ্ট অবস্থা হতে পারে, যদি প্রথম ছাব্বিশটা তাস স্পেডস্‌ বা হার্টস্‌ হয়। যদি আমরা গভীরভাবে ভাবি, প্রত্যেকটা অবস্থাই নির্দিষ্ট, প্রত্যেক অবস্থা একক। প্রত্যেক অবস্থারই একটা নির্দিষ্ট কিছু বিশেষত্ব আছে যেটা অন্য অবস্থা থেকে আলাদা করে। সব তাসকে যদি আমরা আলাদা করতে চাই, তখন দেখা যাবে সব তাসই সমতুল্য। কোনটাই অন্যের থেকে বিশেষ না। বিশেষত্ব তখনই থাকবে, যখন আমরা মহাবিশ্বকে আনুমানিক এবং ঝাপসা অবস্থায় দেখব। বিশ্বকে আমরা ঝাপসা ভাবে বর্ণনা করি বলেই এনট্রপির অস্তিত্ব আছে – বোল্টজম্যান দেখিয়েছিলেন। বিভিন্ন ঝাপসা অবস্থা যাদের পৃথক করা যাচ্ছে না – সেই সংখ্যাটাই এনট্রপির পরিমাপ। অতীতের তাপ, এনট্রপি এবং কম এনট্রপি ধারনা – বিশ্বর আনুমানিক এবং স্ট্যাটিস্টিক্যাল বর্ণনামাত্র। এই অতীত এবং ভবিষ্যতের তফাৎ ঝাপসা অবস্থা থেকেই আসছে। যদি আমরা আণুবীক্ষনিক প্রকৃত অবস্থার বিচার করি তাহলে কি সময়ের প্রবাহ অদৃশ্য হয়ে যাবে? উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ। অতীত এবং ভবিষ্যতের পার্থক্য হয়ে যায়। আমরা অনেক সময় বলি, কারনের পরে প্রভাব আসে। কিন্তু বস্তুর প্রাথমিক অবস্থায় কারন আর প্রভাবের মাঝে কোন তফাৎ নেই। প্রাকৃতিক সুত্রে, যেখানে বিভিন্ন সময়ের মধ্যে যোগসুত্র থাকে, সেখানে কিছু ধারাবাহিকতা থাকে, অতীত এবং ভবিষ্যতের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে। আনুবীক্ষনিক ক্ষেত্রে অতীত এবং ভবিষ্যতের কোন তফাৎ নেই। অতীত এবং ভবিষ্যতের তফাৎ ঝাপসা অবস্থা থেকেই আসছে – এই উপসংহার আমাদের হতচেতন করে দেয়। যদি আমরা অসংখ্য অণুর প্রকৃত নাচ দেখি এবং তাদের হিসাবের মধ্যে আনি, তাহলে কি আমাদের ভবিষ্যৎ, অতীতের মত একই হবে? সময়ের বোঝার যে সাধারন পদ্ধতি আমরা ব্যবহার করি, এই উপসংহারে সেটার অবমূল্যায়ন হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two − 1 =