জোড়া হেলিক্স ছাড়িয়ে

জোড়া হেলিক্স ছাড়িয়ে

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২ মে, ২০২৫

ডি এন এ-র জোড়া হেলিক্স গড়ন অণু-জীববিজ্ঞানের এক অলঙ্ঘনীয় সত্য। কিন্তু দেখা গেছে, কতকগুলি ডি এন এ পর্যায়ক্রম জোড়া হেলিক্স ছাড়া অন্যরকম রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। এইসব বিকল্প গঠনকাঠামোর নাম ‘নন-বি ডি এন এ’। কোষ ঘটিত প্রক্রিয়াগুলির নিয়ন্ত্রণে এবং জিনোমের বিবর্তনে এদের ভূমিকা আছে। জিনঘটিত অসুখ আর ক্যান্সারেও এদের ভূমিকা আছে। আগে এদের সম্পর্কে খুব সুনির্দিষ্ট করে বিশেষ কিছু জানা ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা খুব পূর্ণাঙ্গরূপে বড়ো বনমানুষের জিনোমে এদের নির্দিষ্ট অবস্থান জানাতে পেরেছেন। এদের কাজকর্ম এবং বিবর্তন বোঝার ক্ষেত্রে এটি প্রথম পদক্ষেপ।

২০০১ সালে যখন মানব-জিনোমের রূপ প্রকাশিত হয়েছিল তখন কিন্তু সেটা একেবারে সুসম্পূর্ণ ছিল না। প্রায় ৮% জিনোম তখনকার প্রযুক্তিতে অনির্ণেয় ছিল। জানিয়েছেন মুখ্য গবেষক কাতেরিনা মাকোভা। ২০২২/২৩-এ মানবজিনোমের এই ফাঁক ভরাট করার এক বিপুল প্রয়াস নেওয়া হয়। আর এই ২০২৫-এ একই কাজ সমাধা হল বড়ো বনমানুষদের ক্ষেত্রে। বেশির ভাগ জিনোমের জন্য গবেষকরা এক বিশেষ ধরনের ডি এন পর্যায়ক্রম (সিকোয়েন্স) নিরূপণ প্রযুক্তির আশ্রয় নেন। এই প্রকৌশলে প্রথমে জিনোমগুলোকে কয়েক নিযুত (মিলিয়ন= দশ লাখ) ছোটো ছোটো টুকরোয় ভেঙে নেওয়া হয়। সেগুলোর পর্যায়ক্রম নির্ণয় করে নিয়ে তারপর অনেক কষ্টে একটু একটু করে তাদের আবার জোড়া লাগানো হয়। এই প্রযুক্তির মুশকিল হচ্ছে, এখানে অজস্র একই রকমের গোলকধাঁধা থাকে, যেগুলোকে ঠিকঠাক জোড়া লাগানো খুব কঠিন। নতুন যে-প্রযুক্তি এখন প্রয়োগ করা হচ্ছে, তাতে এই অসুবিধা দূর হয়েছে। এর সুবাদে এখন অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক লম্বা লম্বা টুকরোর মধ্যে জিনোমের পর্যায়ক্রম নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে আগ্রহজনক কিছু কিছু সক্রিয় উপাদান নিয়ে এই প্রথম অনুসন্ধান চালানো যাচ্ছে। ‘নন-বি ডি এন এ’ –ও তারই অন্তর্গত।
কতকগুলি পর্যায়ক্রমের রূপের ভিত্তিতে নন-বি ডি এন এর চেহারা নানারকম হয়। ন্যূব্জ ডি এন এ, চুলের পিনের মতো বাঁকানো ডি এন এ, চারকোণা চেহারার ডি এন এ (জি-৪), জেড-ডি এন এ। সম্প্রতি জানা গেছে, বেশ কিছু কোষ ঘটিত প্রক্রিয়ার সঙ্গে এরা যুক্ত। যেমন কোষ বিভাজনের সময় ডি এন এ-র প্রতিরূপ তৈরির কাজ শুরু করা, জিনের ব্যক্ত রূপকে নিয়ন্ত্রণ করা, ক্রোমোসোমের প্রান্তে অবস্থিত টুপির মতো ‘টেলোমিয়ারে’র কাজ নিয়ন্ত্রণ করা। কোষ বিভাজনের সময় ক্রোমোসোমের ‘সেন্ট্রোমিয়ার’ নামক যে কাঠামোগুলি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেগুলির মধ্যেও এইসব নতুন ডি এন এ কাঠামোর ভূমিকা আছে। মানুষ, শিম্পাঞ্জি, বনোবো, গোরিলা, দুই প্রজাতির ওরাং ওটাং, এছাড়া সিয়ামাং নামক এক ছোটোখাটো বনমানুষের জিনোম অনুসন্ধান করে কোথায় কোথায় নন-বি থাকতে পারে তা নির্ণয় করেছেন গবেষক দল । তাঁরা দেখেন, বনমানুষ প্রজাতির সব সদস্যর মধ্যেই এই নন-বি ছাঁদগুলি মোটের উপর সম মাত্রায় ছড়িয়ে আছে। নন-বি ডি এন এ-দের পরিব্যক্তির হার বেশি এবং স্থিতিশীলতা কম হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। ফলে ডি এন এ-র ছেদবিন্দু গড়ে উঠে ক্রোমোসোমের মধ্যে মধ্যে পুনর্বিন্যাস ঘটতে পরে। জিনোমের বিবর্তন আর কিছু কিছু জিনঘটিত অস্বাভাবিকতার উপর এর প্রভাব থাকতে পারে। সম্প্রতি এক ধরনের ‘ডাউন লক্ষণনিচয়ে’র জন্য দায়ী ২১ নম্বর ক্রোমোসোমের একটি অবস্থানান্তরের (ট্রান্সলোকেশন) ছেদবিন্দুর সঙ্গে এই ধরণের এক ফিরেফিরে-আসা ডি এন এ-র সম্পর্ক লক্ষ্য করা গেছে।
আপাতত অল্প কয়েকটি ছাঁচ বিশ্লেষণ করে গবেষকরা পরীক্ষাসহযোগে দেখাতে পেরেছেন যে নন-বি ডি এন এ বাস্তবে সত্যিই গঠিত হয়। কিন্তু বিপুল সংখ্যক বাকি ছাঁচগুলোর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে হলে বাড়তি প্রমাণ চাই। মাকোভা বলেছেন, নির্দিষ্ট একটা ছাঁদের মধ্যে নন-বি ডি এন এ গড়ে ওঠা একটা নির্দিষ্ট পটভূমির ওপরে নির্ভরশীল যথা কোষের ধরণ, বিকাশের পর্যায়, জিনোমের পটভূমি প্রভৃতি। সম্প্রতি জিনোমের ক্রিয়াকর্ম নিয়ে ভাবনাচিন্তায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। এখন পর্যায়ক্রমের পাশাপাশি কাঠামোকেও বিবেচনার মধ্যে আনার কথা ভাবা হচ্ছে। ভবিষ্যতে নিশ্চয় আরো অনেক কিছু জানা যাবে।
সূত্র: Linnéa Smeds et al, Non-canonical DNA in human and other ape telomere-to-telomere genomes, Nucleic Acids Research (2025). DOI: 10.1093/nar/gkaf298

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

8 + sixteen =