
সাধারণত বাচ্চাদের সঙ্গে গণিতের প্রথম সাক্ষাৎ হয় সকালে নাস্তার সময় কিংবা খেলার মাঠে – ক্লাসঘরে নয়। দৈনদিন অভিজ্ঞতাই রাশি বা পরিমাণ সম্বন্ধে তাদের মনের মধ্যে এক অন্তর্জাত বোধ তৈরি করে দেয়।একটি পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা-প্রতিবেদন অনুযায়ী, শক্তপোক্ত “সংখ্যার বোধ” থাকলে পাটীগণিত সহজ হয়ে যায়। পরে সেটাই বীজগণিত জ্যামিতি আর সাবালক দশার শিক্ষায় সাফল্য এনে দেয়।
আচরণ-বিজ্ঞানসম্মত দীর্ঘমেয়াদি পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে, সেই সঙ্গে স্নায়ু-চিত্র উপাত্তর (ডেটা) সঙ্গে ক্লাসে পড়ানোর বিভিন্ন ছক নিয়ে গবেষণা করে গবেষকরা একটা ‘ত্রি-স্তর চক্রে’র প্রস্তাব দিয়েছেন যাতে তথ্য আর মৌলিক ধারণা পরস্পরকে মদত দেবে। তাঁদের মতে সাবলীলতার সূত্রপাত হয় উপযুক্ত ধারণা থেকে। অনুশীলন মারফত সেটা উন্নত হয়। ভাবনাচিন্তা আর আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে তা গভীরতর হয়। গণিতশিক্ষাকে জ্ঞানের দুটি দশার মধ্যে এক গতিময় চলন হিসেবে কাঠামোবদ্ধ করেছেন তাঁরা। বাচ্চারা একটা স্বজ্ঞাপ্রসূত অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে শুরু করে। দুই বাণ্ডিল পটকাকে মিশিয়ে দিয়ে তারা একটা বড়ো বাণ্ডিল পাবে বলে আশা করে, কিন্তু কেন পাবে তা বলতে পারে না। সুনির্দেশিত নির্দেশ মারফত তারা এইসব আন্দাজকে সুস্পষ্ট কতকগুলো কৌশলে রূপান্তরিত করতে শেখে। তারা “বড়ো সংখ্যা থেকে গুণতে আরম্ভ করে” কিংবা বুঝতে শেখে যে ডান-বাঁ যেদিক থেকেই যোগ করা হোক, দুটো সংখ্যার যোগফল একই থাকে। এর পর স্বল্পমেয়াদি সুপরিকল্পিত শিক্ষাদান মারফত ওইসব প্রকট কৌশলগুলো হয়ে ওঠে স্বয়ংক্রিয়। তখন তাদের ভারমুক্ত মন উচ্চতর মাত্রার সমস্যা সমাধানের দিকে মন দিতে পারে। স্নায়ু-চিত্র গবেষণা দেখা যায়, এই প্রক্রিয়াটা যত এগোতে থাকে, মস্তিষ্কের সক্রিয়তার ছাঁদ বদলাতে শুরু করে। চেষ্টা করে বিচার করার পর্যায় থেকে এক লহমায় মনে-করার পর্যায় শুরু হয়। আস্তে আস্তে গুণে গুণে সংখ্যা বিচারের বদলে তৎক্ষণাৎ স্মৃতি উদ্ধারের পর্ব শুরু হয়। গবেষকদের মতে, মৌলিক ধারণা আর ক্রিয়াপদ্ধতির সাবলীলতা, এ দুয়ের যুগপৎ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সাবলীলতা জড়িত। কাজেই ক্লাসঘরের শিক্ষাদান যেন এই দুটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়মিত চক্র রচনা করে।
মনের মধ্যে সংখ্যাগুলো যেভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে তার মধ্যে ফাঁক কোথায়, প্রথম থেকেই তার উপর নিয়মিত নজর রাখতে হবে। চিন্তভাবনার কৌশল শেখানো যেতে পারে, যথা একক-দশকের ঘর বোঝানো। এগুলো তাদের ফাঁক বোজাতে সাহায্য করবে। স্মৃতি উদ্ধার করার অনুশীলনগুলি হবে ছোটো ছোটো, যাতে আগে ত্রুটিহীনতা অর্জন করবার পর তবেই চটপট করে ফেলার উপর জোর পড়ে। প্রতিটি সময়-বাঁধা অনুশীলন পর্বর শেষে যেন একটি করে দলবদ্ধ আলাপ আলোচনার পর্ব থাকে। বাচ্চারা সেখানে পদ্ধতিগুলোকে ব্যাখ্যা করবে, তথ্যকে প্রশস্ততর ধারণার সঙ্গে যুক্ত করবে। এই ব্যাখ্যা -> অনুশীলন -> ব্যাখ্যা ছন্দটি মুখস্থবিদ্যার বিপদ এড়াবে, সেই সঙ্গে জ্ঞানকে প্রয়োজনমতো আপনা থেকেই কাজে লাগানোর প্রক্রিয়াটি সুনিশ্চিত করবে।
কম্পিউটার ভিত্তিক শিক্ষণ সিস্টেমগুলি এবং অভিযোজনমূলক অনুশীলন অ্যাপগুলি তখনই কাজ দেবে যখন শিক্ষকরা সেগুলিকে মৌলিক ধারণা নিয়ে আলাপ আলোচনার সঙ্গে আর বিষয়গুলি নিয়ে ভাবনাচিন্তার সঙ্গে সামগ্রিকভাবে অন্বিত করে নিতে পারবেন। গবেষকদের মতে, শিক্ষালাভের বিজ্ঞান প্রমাণ করে যে পাটীগণিতে পটুতা কেবল মুখস্থবিদ্যার ও অনুসন্ধানের উপর নির্ভর করে না, এটা ও-দুটির এক সচেতন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। শিক্ষার আরও বহু ক্ষেত্রেরই মতন, গণিত শিক্ষাতেও ভারসাম্য আর সাক্ষ্যপ্রমাণ হাত ধরাধরি করে চালে।
ডেলাওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যান্সি জর্ডান, উইসকনসিন ও-ক্লেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের আলেকজান্ড্রিয়া ভিয়েগুট আর ওয়েস্টার্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যানিয়েল আনসারি একত্রে এই গবেষণাটি করেছেন। গবেষণাপ্ত্রটি প্রকাশিত হয়েছে সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স ইন দ্য পাবলিক ইন্টারেস্ট পত্রিকায়।