সাপেরাও শুনতে পায়

সাপেরাও শুনতে পায়

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১০ মে, ২০২৫

সাপ কি কেবল মাটির মধ্যে দিয়ে শব্দের কম্পন অনুভব করতে পারে? না। জানা যাচ্ছে তারা বাতাসে ভেসে আসা শব্দও অনেকসময় শুনতে পায়। বায়ুবাহিত শব্দ কম্পন, সাপেরা আদৌ শুনতে পায় না কিনা সেই নিয়ে প্রচুর বিভ্রান্তি ছিল। তবে ‘প্লস ওয়ান’ পত্রিকাতে প্রকাশিত নতুন এক গবেষণা দেখাচ্ছে, সাপেরা শ্রবণশক্তি ব্যবহার করে এবং নিজেদের মতন করে চারপাশের পরিবেশকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। সুতরাং সব সাপই বায়ুবাহিত শব্দের প্রতি বধির নয়।
এই গবেষণায় সাতটি প্রজাতির ১৯ টি ভিন্ন সাপকে পর্যবেক্ষণ করে বোঝা যায়, তারা কেবলমাত্র বায়ুবাহিত শব্দ শুনতে পায় তাই নয়, বরং ভিন্ন শব্দের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া হয় ভিন্নরকম। চারপাশের পরিবেশকে অনুভব করার জন্য, সাপের কাছে প্রধান উপায় হল দেখা এবং বাতাস থেকে কোন বস্তুর স্বাদ গ্রহণ করা। তবে দেখা যাচ্ছে, সাপের সংবেদনশীলতার ভান্ডারে এই শ্রবণশক্তিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটি যুক্তিসঙ্গত। টিকটিকি, বিড়াল, কুকুর এবং অন্যান্য সাপের মতন শিকারিদের প্রতি এরা বিশেষ সংবেদনশীল। শিকারিদের এড়ানো বা আঘাত থেকে বাঁচতে, বিশেষ করে পদদলন এড়াতে, তারা এই শ্রবণশক্তিকে ব্যবহার করে। কুইনসল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি এবং স্কুল অফ ক্রিয়েটিভ প্রাক্টিস যৌথ উদ্যোগে শব্দরোধী ঘর তৈরি করে এই সাপগুলিকে নিয়ে পরীক্ষা করে। এক্ষেত্রে নীরব দশাকে নিয়ন্ত্রণ মাত্রা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তিন মাত্রার শব্দ যেমন ১-১৫০Hz, ১৫০-৩০০ Hz এবং ৩০০-৪৫০Hz কম্পাঙ্কের শব্দ ব্যবহার করা হয়। উল্লেখ্য, মানুষের কন্ঠ স্বরের পরিসর ১০০-২৫০Hz এবং পাখিদের কিচিরমিচিরের পরিসর ৮০০০Hz এরও বেশি। পূর্ববর্তী গবেষণায়, গবেষকরা পশ্চিমা ডায়মন্ডব্যাক ৱ্যাটল স্নেককে একটি স্টিলের জালি করা ঝুড়িতে ঝুলিয়ে রেখে ২০০-৪০০Hz ক ম্পা ঙ্ক শব্দ প্রতিক্রিয়ায় তাদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করেন। অন্য আরেকটি গবেষণায় আংশিকভাবে অজ্ঞান করা সাপের মস্তিষ্কে তড়িত দ্বার বসিয়ে, ৬০০Hz শব্দের প্রতিক্রিয়ায় তার মস্তিষ্কের ক্রিয়া নথিভুক্ত করা হয়। এই গবেষণাটি প্রথম, একাধিক সাপ প্রজাতি যারা অবাধে বিচরণ করতে পারে এমন স্থানে শব্দের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়। এক্ষেত্রে, গবেষকরা শব্দগুলি ভূমিতে কম্পন তৈরি করে কিনা তা শনাক্ত করতে অ্যাক্সিলোমিটার ব্যবহার করেন। তাতেই জানা যায়, সাপগুলি ভূমিতে অনুভূত কম্পন অনুসরণ করছে না বরং বায়ুবাহিত শব্দ ব্যবহার করছে। বেশিরভাগ সাপ শব্দ পরীক্ষায় ভিন্ন ধরনের আচরণ দেখায়। ওমা পাইথন ( অ্যাসপিডাইটস রামসাই) অস্ট্রেলিয়ার শুষ্ক অঞ্চল জুড়ে থাকে। শব্দের প্রতিক্রিয়ায়, অবিষাক্ত এই সাপগুলির চলাচল উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়, প্রকৃতপক্ষে তারা শব্দের একেবারে উৎসের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। তারা পেরিস্কোপিং নামক একটি আকর্ষণীয় আচরণ প্রদর্শন করে যেখানে তারা,তাদের শরীরের সামনের তৃতীয়াংশ এমনভাবে তুলে ধরে যা কৌতূহলের ইঙ্গিত সূচক। বিপরীতে আরও তিনটি প্রজাতি – অ্যাকান্থেফিস, অক্সিউরানাস এবং সিউডোনাজা – শব্দের উৎসকে এড়িয়ে চলাচল করে। ডেথ অ্যাডোরা কৌশলের দ্বারা শিকার করে থাকে। এরা, নিজেদের লেজের উপরে থাকা পোকার মতন দেখতে অংশটিকে নাড়াচাড়া করে এবং শিকারের কাছে আসার জন্য অপেক্ষা করে। এরা খুব দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাফেরা করতে পারে না। শব্দ থেকে দূরে সরে যাওয়ার প্রবণতা তাদের মধ্যেও লক্ষ্য করা গেছে। মূলত ক্যাঙ্গারু বা মানুষের মতন বৃহৎ মেরুদন্ডী প্রাণীদের দ্বারা পদদলিত হয়ে যাওয়া এড়ানোর জন্যই এরা এমনটা করে থাকে। অন্যদিকে বাদামি সাপ এবং তাইপান হল সক্রিয় শিকারি, যারা দিনের বেলায় দ্রুত শিকারের পিছনে ছুটতে থাকে। পরীক্ষা দেখা গেছে, এই দুই সাপেরই ইন্দ্রিয়শক্তি তীব্র। বিশেষ করে তাইপানরা শব্দের প্রতিক্রিয়ায় প্রতিরক্ষামূলক এবং সতর্কতাসূচক আচরণ দেখায়। সুতরাং সাপ যে বধির নয় একথা অনেকাংশেই প্রমাণিত। তারা শুনতে পায় ঠিকই, তবে মানুষের মতন নয়। মূলত ৬০০Hz এর নীচের কম্পাঙ্কের শব্দ তারা শুনতে পায়। আমরা যা কথাবার্তা বলি অনেক সময় তারই অস্পষ্ট সংস্করণ সাপেরা শোনে। এই গবেষণা আমাদের অনেকটাই সতর্ক করে, মানুষের উচ্চস্বরে কথা বলা বা চিৎকার সাপ শুনতে পায়। তবে স্বাভাবিক কথোপকথন যা ৬০ ডেসিবেলের মতন, তা এখনো পরীক্ষার আওতায় আসেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three − one =