লাদাখে নতুন প্রস্তরচিত্র আবিষ্কার

লাদাখে নতুন প্রস্তরচিত্র আবিষ্কার

অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক্সপ্লোরেটারি পর্বতারোহী
Posted on ১০ মে, ২০২৫

লাদাখের এক ছোট্ট গ্রাম লাটো। তার দক্ষিণ-পশ্চিমে তারগিউক নামের এক উপত্যকায় অনুসন্ধানী পর্বতারোহণ করতে গিয়ে রোদ-ঝলসানো এক পাথুরে চাঙরের ওপর অদ্ভুত কিছু আঁকিবুঁকি নজরে পড়ল। ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেল, ওগুলো কতকগুলো ছবির রূপরেখা, সম্ভবত জন্তু জানোয়ারের। এরকম আরও অনেক ফ্যাকাশে রেখাচিত্র পাওয়া গেল আশপাশের অনেক লালচে-ব্রাউন শিলার গায়।

2025-এর মার্চ মাস। গোটা লাদাখ জুড়ে শেষ-শীতের প্রচণ্ড ঝড় আর ব্যাপক তুষারপাত হয়েছে। আমরা আটকে পড়েছিলাম। জমাট নদীর উপরে একটা ঘুরপথ ধরে আমরা বেরোবার চেষ্টা করছিলাম। তখনই এই অবাক-করা আবিষ্কারটা করলাম। প্রথম চোখে পড়ল সৌরভ (দাস) এবং আনন্দ-র ( মুখার্জি)। কোনো সিদ্ধান্তে না-এসে আগে যোগাযোগ করলাম ডঃ সোনম ওয়াংচোক-এর সঙ্গে। উনি লাদাখি কৃষ্টির শ্রদ্ধেয় বিশেষজ্ঞ। তিনি জানালেন, এই ক্ষেত্রে আগে অনুসন্ধানের কোনো খতিয়ান নেই।

হাজার হাজার বছরের পুরোনো এইসব চিত্ররেখার সামনে নত হয়ে চেয়ে রইলাম। দৃশ্যগুলো শিকারের। পাথরে-কোঁদা বাঁকা-শিং পাহাড়ি ছাগল, গাঁট্টাগোঁট্টা পোষ না-মানা ভেড়া। এসবই লাদাখের বিশাল কিন্তু অল্প-জানা ঐতিহ্যের অঙ্গ। সেখানকার উঁচু উঁচু উপত্যকায় এরকম অনেক হাজার হাজার বছরের পাথুরে চিত্র (পেট্রোগ্লিফ) ছড়িয়ে আছে। গবেষকদের মতে, এদের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনোগুলোর বয়স পাঁচ হাজার বছর। এগুলো বোঞ্জ যুগের। কাছাকাছি অঞ্চলের কার্বন ডেটিং করে জানা গেছে সুদূর খ্রিস্টপূর্ব ৪৭০০-এ এখানে মানুষের বসতি ছিল। প্রাগৈতিহাসিক যুগের শিল্পীরা এইসব শক্তপোক্ত ধূসর প্রস্তরখণ্ডগুলোকেই বেছে নিয়েছিলেন। তাঁদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের, তাঁদের বিশ্বাসের চিত্ররূপ খোদাই করে গিয়েছিলেন। কালে কালে শিকার আর নাচের দৃশ্য, পূজাপদ্ধতি আর প্রতীকচিত্রও এঁকেছিলেন। খ্রিপূ ১০০০-৭০০ পর্বে এখানে হিমালয় অঞ্চলের ব্রোঞ্জ যুগের আর বিস্তীর্ণ ইউরেশীয় তৃণভূমি অঞ্চলের কৃষ্টি ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছিল। তা থেকেই সূত্রপাত এক শিলা-শিল্পের ঐতিহ্যর। সে-ঐতিহ্য অবিচ্ছিন্নভবে প্রবাহিত হয় খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দর শুরুর দিক অবধি। পুরাতত্ত্ববিদরা জানাচ্ছেন, এই শিলা-শিল্পর ঐতিহ্য চরম রূপ ধারণ করে তিব্বতের বড়ো বড়ো ধর্মে, যথা বৌদ্ধধর্ম আর বন। লাদাখের যেকোনো উপত্যকায় মিলবে এইরকম প্রস্তরচিত্রর নিদর্শন। নিম্নবর্তী সিন্ধু (শাম), নুব্রা (শায়ক), চাংথাং, কারগিল, জানস্কার প্রভৃতি পাঁচশোরও বেশি ক্ষেত্রর খতিয়ান এখন জানা হয়ে গেছে।
লাদাখের অকরুণ জলবায়ুর দাপট সামলে এই শিলা-খোদাইগুলো টিকে গেছে। সবার আগে এসেছিল তুষারযুগের শিকারীরা, তারপর মধ্যযুগের সৈন্যসামন্ত কুচকাওয়াজ করেছিল, সবারই চিহ্ণ রয়ে গেছে। বিখ্যাত আলচি ক্ষেত্রের প্রস্তরখণ্ডগুলোয় শিকারের দৃশ্য আর পোষ না-মানা ছাগলের ছবি খোদাই করা হয়েছিল ব্রোঞ্জ/লৌহ যুগের শৈলীতে। তার কয়েক শতক পর ৯-১১ খ্রিস্টাব্দে ওই একই পাথরে নতুন করে খোদাই করা হয় বৌদ্ধ স্তূপ। এইভাবে লাদাখের প্রগৈতিহাসিক প্রাক্‌-বৌদ্ধ গুণিন যুগের কৃষ্টির সঙ্গে ধারাবাহিকতা রেখে চলে মন্দির-যুগের ঐতিহাসিকতা। এই অবিচ্ছিন্ন প্রবাহের মধ্যেই ঘটল লাতো গ্রামে আমাদের এই আবিষ্কার। খুব সম্ভব এটি ওই প্রাক-বৌদ্ধ ব্রোঞ্জ/লৌহ যুগ পর্বের অন্তর্গত। লাদাখের সুদূর অতীত সম্বন্ধে মহামূল্য কিছু বাড়তি তথ্য জানা গেল এইভাবে।
কী দেখলাম আমরা? খোদাই-করা পাথরের মধ্যে প্রধানত ছিল পাহাড়ি ছাগল, বুনো ভেড়া, হরিণ, ইয়াক ও অন্যান্য শিকারের প্রাণী। লম্বা, বাঁকানো শিংওয়ালা বুনো ছাগলের ছবি যত্রতত্র। শিকারের প্রাণীর পাশাপাশিই রয়েছে তির-ধনুক, বর্শা আর বাঁশি হাতে শিকারী পুরুষদের চিত্র। এর মধ্য দিয়ে তাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠী এবং নানান রীতি ও জীবনের বিভিন্ন পর্বের সংস্কারের পরিচয়ও ফুটে উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লৌহ যুগ যখন এল ততদিনে শিকারের ব্যাবহারিক গুরুত্ব কমে এলেও তার কৃষ্টিগত মর্যাদা আর কেন্দ্রীয় স্থানটি রয়ে গিয়েছিল। এছাড়া রয়েছে ব্রোঞ্জ যুগের শৈলীতে আঁকা বড়ো বড়ো চোখওয়ালা গোলগোল মুখোশ-প্রতিম মুখ। কতকগুলো পাথরে রয়েছে নৃত্যরত মানুষ, ঘোড়সওয়ার, এমনকি কিছু মানুষের রেখাচিত্র। কিছু জ্যামিতিক চিত্রও রয়েছে যা থেকে জাল-ছক, গোলকধাঁধা, মানচিত্র এমনকি গুণিনদের মাদুলি প্রভৃতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

আমরা পর্বতারোহী, আমরা এখানে আগন্তুক। একই সঙ্গে আমরা এই ক্ষেত্রগুলির সেবায়েতও বটে। তাই লাতো-র এইসব প্রস্তরচিত্রগুলির আলোকচিত্র নেওয়ার পর শিলাগুলি যেমন ছিল সেই অবস্থাতেই রেখে এসেছি। আধুনিক অভিযাত্রীদের এ ব্যাপারে একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। আমরা যেন একটা অঞ্চলের প্রাচীন কৃষ্টি-ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক জগতের প্রথম সেতু। আমরা গবেষকদের সতর্ক-বার্তা পাঠাই, সহ-অভিযাত্রীদের শিক্ষা দিই।

(তারগিয়ুক অভিযানের মোট চার সদস্য ছিল – সৌরভ দাস, আশীষ চন্দ, আনন্দ মুখার্জি এবং লেখক। )
সূত্র: Anindya Mukherjee, Discovering Ladhakh’s Uncharted Petroglyphs: A Short Note, May 03, 2025। himalaya-raja.blogspot.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five + sixteen =