‘ফিনিশিয়ান’ সভ্যতার নয়া ইতিহাস

‘ফিনিশিয়ান’ সভ্যতার নয়া ইতিহাস

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১২ মে, ২০২৫

ব্রোঞ্জ যুগে, লেভান্ট নগরে, ‘ফিনিশিয়ান’ সভ্যতার উৎপত্তি হয়। প্রথম বর্ণমালা, যা আধুনিক লিখন পদ্ধতির অনেকগুলিরই উৎস, তার উদ্ভব ঘটে, এই সভ্যতাতেই। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের গোড়ার দিকে, এই ফিনিশিয়ান শহরগুলি ছিল বাণিজ্যিক বন্দর ঘাঁটি। আইবেরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্যিক বন্দরগুলির একটি বিস্তৃত সামুদ্রিক পথ-জাল তৈরি ছিল। এই বন্দর-জালগুলির মাধ্যমে, তারা মধ্য এবং পশ্চিম ভূমধ্যসাগর জুড়ে তাদের সংস্কৃতি, ধর্ম এবং ভাষা ছড়িয়ে দেয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে, বর্তমান তিউনিসিয়ার উপকূলে অবস্থিত কার্থেজ, এই অঞ্চলগুলির মধ্যে প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় ঘাঁটিতে পরিণত হয়। কৃষ্টি গত দিক থেকে, কার্থেজের সাথে যুক্ত বা তার দ্বারা শাসিত ফিনিশীয় সম্প্রদায়গুলি, রোমানদের কাছে ‘পুনিক’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ইতিহাসে, রোমান প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে, পুনিক যুদ্ধের প্রতিনিধি হিসাবে কার্থেজ স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। জেনারেল হ্যানিবল, আল্পস অতিক্রম করার বিখ্যাত সামরিক অভিযানও এই যুদ্ধের অন্তর্ভুক্ত। ‘ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ইভোলিউশনারি অ্যানথ্রোপলজির’, জোহানেস ক্রাউস এবং ‘হার্ভার্ড’ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইকেল ম্যাককরমিকের যৌথ আন্তর্জাতিক গবেষণা, জিনগত তথ্য প্রমাণ প্রকাশ করে, এই প্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কে নতুন ধারণা দেয়। ফিনিশিয়ান সংস্কৃতির প্রসারের উপর, এই গবেষণার লক্ষ্য ছিল, প্রাচীন ডিএনএ ব্যবহার করে পুনিক মানুষের পূর্বপুরুষদের চিহ্নিত করা। তাদের এবং লেভান্তাইন ফিনিশিয়ানদের মধ্যে জিনগত সংযোগ অনুসন্ধান করা। কারণ, এদের মধ্যে সাধারণ সংস্কৃতি এবং ভাষার বেশ মিল ছিল। লেভান্ত, উত্তর আফ্রিকা, আইবেরিয়া এবং সিসিলি, সার্ডিনিয়া এবং ইবিজার ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের ১৪টি ফিনিশিয়ান এবং পিউনিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে সমাহিত মানব দেহাবশেষ থেকে জিনোমের একটি বৃহৎ নমুনা ক্রম তৈরি এবং বিশ্লেষণ করেন। এই প্রসঙ্গে প্রধান গবেষক হ্যারাল্ড রিংবাউয়ার বলেন, “পশ্চিম ও মধ্য ভূমধ্যসাগরীয় পিউনিক বা পুনিক জনসংখ্যার উপর লেভান্তিয় ফিনিশিয়ানদের সরাসরি জিনগত অবদান আমরা আশ্চর্যজনকভাবে খুব কমই খুঁজে পাই। গণ অভিবাসন নয়, বরং কৃষ্টিগত সংযোগ এবং তা আত্তীকরণের একটি গতিশীল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফিনিশিয়ান সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ে”। গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে যে পিউনিক স্থানগুলিতে বিভিন্ন বংশোদ্ভূত, ভিন্ন ধরনের মানুষের বাস ছিল। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স এবং হিউম্যান বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক, ডেভিড রেইচ বলেন, “আমরা পিউনিক বিশ্বে একটি জিনগত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করি, যা অসাধারণভাবে ভিন্নধর্মী ছিল। প্রতিটি স্থানে, মানুষ বংশগত দিক থেকে অত্যন্ত আলাদা প্রকৃতির ছিল। সবচেয়ে বড় জিনগত উৎস ছিল সিসিলি এবং এজিয়ানের সমসাময়িক মানুষেরা। আরও উল্লেখযোগ্য ছিল, উত্তর আফ্রিকা-সম্পর্কিত বংশধরেরা। প্রাচীন ডিএনএ, পুনিক বিশ্বের সার্বজনীন প্রকৃতির উপর জোর দেয়। উত্তর আফ্রিকান বংশধররা কার্থেজ সহ সমস্ত নমুনাযুক্ত পুনিক স্থানগুলিতে প্রধানত সিসিলিয়ান-এজিয়ান বংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পাশেই, একেবারে মিলেমিশে বাস করতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, ভূমধ্যসাগর জুড়ে জিনগত মানচিত্র ইঙ্গিত দেয়, সম্প্রদায় গঠনে – বাণিজ্য, আন্তঃবিবাহ এবং জনসংখ্যার মিশ্রণ, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষকরা, একজোড়া নিকটাত্মীয় (খুরতুতো ভাই) খুঁজে পান। যাদের একজন উত্তর আফ্রিকার একটি পুনিক স্থানে এবং অন্যজন সিসিলিতে সমাহিত রয়েছেন। সহ অধ্যাপক ইলান গ্রোনাউ বলেন, “এই গবেষণাগুলি, প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় সমাজগুলির মধ্যে গভীর আন্তঃসংযোগের ধারণাটিকে আরও জোরদার করে তোলে।” উপসংহারে তিনি জানান, এই মানুষগুলি প্রায়শই বিশাল ভৌগোলিক দূরত্ব পেরিয়ে মিশে যেত। অন্যদিকে গবেষণায় প্রাচীন ডিএনএর গুরুত্ব কতটা অপরিসীম তাও বোঝা যায়। ঐতিহাসিক জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ এবং বিবর্তনের উপর আলোকপাত করতে, প্রাচীন ডিএনএগুলি, তুলনামূলক বিরল এবং প্রত্যক্ষ ঐতিহাসিক প্রমাণ হিসেবে কাজ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

7 + five =