
সামুদ্রিক ঘাস একধরনের ফাইটোপ্ল্যাংকটন। এরা সমুদ্রের অগভীর স্তরে বেড়ে ওঠে। এদের উপর নজর পড়ে তখনই যখন এদের পাতাগুলো সমুদ্রে ভেসে আসে। কিন্তু জলের নিচের এই নিরহংকার, বিনয়ী উদ্ভিদগুলিই আমাদের গ্রহে কার্বন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদের শোষিত কার্বন “ব্লু কার্বন” নামে পরিচিত। গবেষকরা বলেন, এই তৃণজাতীয় উদ্ভিদগুলো তাদের সরু সরু পাতার নীচে অনেকখানি কার্বন আটকে রাখতে পারে, যা প্রকৃতিকে সুরক্ষা দেয় এবং বায়ুমণ্ডলে ক্রমবর্ধমান কার্বন-ডাইঅক্সাইড-এর স্তর তৈরীতে বাধা দেয়। বহুবছর ধরে তথ্য সংগ্রহের পর, এই বিষয়গুলি বিশ্বের বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শীর্ষ গবেষক ছিলেন ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ড: জোহানেস আর. ক্রাউস।
সামুদ্রিক ঘাসগুলি উপকূলের খুব কাছাকাছি জায়গায় বেড়ে ওঠে বলে জলদূষণ, অতিরিক্ত পুষ্টিপ্রবাহ এবং জলে অতিরিক্ত পলি জমা প্রভৃতি সমস্যার মুখোমুখি হয়। তবে যত প্রতিকূল পরিবেশই হোক, এরা কার্বন শোষণ করে চলে এবং তাদের মূলে ও চারপাশের মাটিতে সংরক্ষণ করে। শুঢু তাই নয়, এরা মাছের আশ্রয়স্থল তৈরী করে এবং উপকূলীয় ক্ষয় রোধ করে। অনেক সামুদ্রিক প্রাণী তাদের প্রজনন ও খাদ্যের জন্য এই তৃণভূমির ওপর নির্ভরশীল। একটি মূল্যায়নে দেখা গেছে যে, এই সামুদ্রিক ঘাসমাটির উপরের ১২ ইঞ্চিতে প্রতি ২.৪৭ একরের জন্য আনুমানিক ২৪.২ মেট্রিক টন জৈব কার্বন সংরক্ষিত করে রাখে। আগে ধারণা ছিল, এই উদ্ভিদগুলো শুধুমাত্র নির্দিষ্ট অঞ্চল বা প্রজাতিতে বৃহৎ সংরক্ষণ ভান্ডার তৈরী করে।
বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে উপকূলীয় উন্নয়ন, জলদূষণ এবং সমুদের একেবারে গভীর থেকে মাছ ধরা প্রভৃতি কারণে এই তৃণভূমিগুলো বিঘ্নিত হচ্ছে। এর ফলে বহু শতাব্দী ধরে সংরক্ষিত কর্বন ছাড়া পেয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশে যেতে পারে। সামুদ্রিক ঘাস মারা গেলে তার কার্বনসংরক্ষিত স্তরগুলি তরঙ্গ ও স্রোতের সংস্পর্শে আসে। ফলে কার্বন জারিত হয়ে কার্বন ডাইঅক্সাইড প্রবাহের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এই মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড-এর বৃদ্ধি গ্রিনহাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনাকে ব্যাহত করে।
বাস্তুতন্ত্রের এই ব্যাপক ক্ষতি অব্যাহত থাকলে নিশ্চিতভাবে এটি অর্থনৈতিক ক্ষতিরও কারণ হয়ে দাঁড়াবে। হয়তো ভবিষ্যতে কার্বনমুক্তির সামাজিক খরচ কয়েক বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে। সামুদ্রিক তৃণভূমি কার্বন সংরক্ষণের পাশাপাশি স্থানীয় অর্থনীতি ও কৃষ্টির জন্যও সমানভাবে গুরুত্বপুর্ন। এটি স্বাস্থ্যকর মাছের মজুত বজায় রাখতে এবং উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রকে সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে জলবায়ুর বিপর্যয়গত ঝুঁকি হ্রাসে সাহায্য করে।
বিজ্ঞানীরা একমত যে, সামুদ্রিক ঘাসের বিস্তৃতির একটা নির্ভরযোগ্য মানচিত্রায়নের প্রয়োজন। তার অভাবে অনেক সময় প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসব তৃণভূমির উপস্থিতি অজানাই থেকে যায়। এই অঞ্চলগুলোর সংরক্ষণই বহুমুখী সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায়। গবেষকরা আশা রাখেন, সঠিক সময়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত ও জনসচেতনতা এই উদ্ভিদের তৃণভূমিকে একটি স্থায়ী কার্বন সংরক্ষকের রূপ দিতে পারবে।