পারস্য থেকে আসা একটা মোমে মোড়া ট্যাবলেটে যে গোপন তথ্য আছে (পারসীরা গ্রীসকে আক্রমণ করতে পারে – এই ধরনের এক আগাম সতর্কতা), সেটা বুঝতে পেরে গর্গো (Gorgo) নামের এক মহিলা গ্রীসকে বাঁচিয়েছিলেন। গর্গোর এক ছেলের নাম প্লেয়েইস্টারচাস (Pleistarchus), যাঁর বাবা স্পার্টার রাজা লিওনিডাস (Leonidas)। লিওনিডাস আবার গর্গোর কাকা, গর্গোর বাবা ক্লিওমেন্সের (Cleomenes) ভাই। তাহলে লিওনিডাসের একই প্রজন্মে কে আছেন? গর্গো, যিনি তাঁর ছেলের মা, নাকি ক্লিওমেন্স – যাঁর সহোদর ভাই লিওনিডাস?
এই বংশতালিকার সাথে বিশ্বের সময়ের গঠনের এক অদ্ভূত সাদৃশ্য আছে। আপেক্ষিকতা তত্ত্বে সময়ের এই গঠনতত্ত্ব বলা আছে। লিওনিডাসের একই প্রজন্ম কে – ক্লিওমেন্স না গর্গো, এই প্রশ্নের কোন মানেই হয় না কারণ ‘এক প্রজন্ম’ বলতে কোন একক ধারনা বোঝায় না। আমরা যদি বলি, লিওনিডাস এবং ক্লিওমেন্স একই প্রজন্মের কারণ তাঁদের বাবা এক, আবার এও বলতে পারি লিওনিডাস এবং গর্গো একই প্রজন্মের কারণ প্লেয়েইস্টারচাস তাঁদের ছেলে, তাহলে তো বলতে হয় গর্গো এবং তাঁর বাবা ক্লিওমেন্স একই প্রজন্মের। এই সন্তানোচিত সম্পর্ক একটা ক্রম প্রতিষ্ঠিত করেঃ ক্লিওমেন্স অ্যানাক্সনড্রিডাসের পরে এসেছেন আর প্লেয়েইস্টারচাসের আগে এসেছেন। এর মাঝে আর অন্য কোন মানুষ নেই। লিওনিডাস এবং গর্গোর কেউই দুজনের আগে বা পরে আসেন নি।
অঙ্কবিদ্দের কাছে ‘আংশিক ক্রম (Partial Order)’ বলে এক শব্দবন্ধ আছে। যে কোন নির্দিষ্ট উপাদানের আগের এবং পরের মধ্যে যে সম্পর্ক তাকেই আংশিক ক্রম বলা হয়। এ ক্ষেত্রে যে কোন দুটোর মধ্যে কোন সম্পর্ক থাকে না। মানুষ, পরিস্রাবণের মাধ্যমে এইরকম আংশিক ক্রমের একটা সেট (Partial Ordered State) গঠন করে। পরিস্রাবণ একটা ক্রম প্রতিষ্ঠা করে ( উত্তরপুরুষের আগে এবং পূর্বপুরুষের পরে ) কিন্তু সবার মধ্যে নয়।
চিত্র (১)
গর্গোর পারিবারিক গাছ যদি দেখি তাহলে তা নীচের ছবির মতো হবে।
ওপরের ছবিতে দুটো শঙ্কু আঁকা হয়েছে। গর্গোকে কেন্দ্র করে এই শঙ্কুদুটো আঁকা হয়েছে। একটা অতীত শঙ্কু এবং ভবিষ্যৎ শঙ্কু। অতীত শঙ্কুতে গর্গোর পূর্বপুরুষরা আছেন আর ভবিষ্যৎ শঙ্কুতে তাঁর ছেলে রয়েছেন। যাঁরা উত্তরপুরুষ বা পূর্বপুরুষের সাথে সম্পর্কযুক্ত নন তাঁরা এই শঙ্কুর বাইরে অবস্থান করবেন।
মহাবিশ্বের সময়ের গঠনেও এর সাথে সাদৃশ্য আছে। এটাও শঙ্কু দিয়ে গঠিত। ‘সময়ের অগ্রাধিকার’-এর সম্পর্কগুলো শঙ্কুর আংশিক ক্রম নিয়ে গঠিত। বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদে যে আবিষ্কারটি হয়েছে তা হোলঃ মহাবিশ্বে ঘটনাগুলোর ক্রম যেভাবে বর্ণনা করা হয় তা আংশিক, পরিপূর্ণ নয়। বর্ধিত বর্তমানের ঘটনাগুলো অতীত বা ভবিষ্যৎ — কোনো ক্ষেত্রেই পড়েনা।
যদি আমরা মহাবিশ্বের সমস্ত ঘটনা এবং তাদের সময়ের সম্পর্ক বর্ণনা করি, তাহলে আমরা অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ কে কোন একক, সার্বজনীন বিভাজন করতে পারব না। বরং আমরা প্রতিটি ঘটনার ওপরে এবং নীচে যথাক্রমে ভবিষ্যৎ এবং অতীত শঙ্কু আঁকব। নীচের ছবিতে যেমন এঁকেছি। ওপরের ছবির সাথে এটার একটা তফাৎ আছে। ওপরে অতীত শঙ্কু ওপরে আর এখানে নীচে। পদার্থবিদ্যায় সবসময় আমরা এইভাবেই অতীত আর ভবিষ্যৎ কে চিহ্নিত করি।
চিত্র (২)
প্রত্যেক ঘটনারই অতীত এবং ভবিষ্যৎ আছে এবং বিশ্বের কিছুটা অংশে অতীত বা ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। সব মানুষেরই পূর্বপুরুষ এবং উত্তরপুরুষ আছে আর অন্যদের পূর্বপুরুষ বা উত্তরপুরুষ বলে কিছু নেই।
আলো তির্যকপথে গমন করে এবং এটি শঙ্কুকে সীমাবদ্ধ করে। এর জন্যই আমরা ‘আলো-শঙ্কু (Light cones)’ বলি।
আমরা যে ধরনের স্কেলে অভ্যস্ত তাতে আলো-শঙ্কু এইরকম খাড়া না হয়ে প্রায় অনুভূমিক ধরা হয়, যেখানে বর্ধিত বর্তমান, যা অতীতকে ভবিষ্যৎ থেকে পৃথক করে, ভীষনভাবে সংক্ষিপ্ত (কয়েক ন্যানো সেকেন্ড মাত্র!)। বর্তমান প্রায় অদৃশ্য, যা একটা সরু অনুভূমিক পটি। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এক সাধারনের বর্তমানের কোন অস্তিত্ব নেই। স্থান-কাল জ্যামিতিতে সময়ের স্তরবিন্যাস হয় না।
স্থান-কালের এই গঠন পঁচিশ বছরের আইনস্টাইন বুঝতে পেরেছিলেন। দশ বছর পরে তিনি বুঝলেন, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সময়ের প্রবাহের পরিবর্তন হয়। কাজেই যে স্থান-কালের কথা ওপরে বলা হোল তা প্রকৃতপক্ষে একইরকম থাকে না, বিকৃত হয়।
এই শঙ্কুর গঠন এমনই যে তার অভিমুখ সবসময়ই ভবিষ্যতের দিকে। ভবিষ্যতের দিকে একটানা পথের শেষে আমরা আবার যে ঘটনার সুত্রপাতের স্থান-কাল বিন্দুতে ফিরে আসি। এই বিষয়টা বিংশ শতাব্দীর যুক্তিবিদ এবং আইনস্টাইনের শেষ বন্ধু কার্ট গোডেল (Kurt Godel) লক্ষ করেছিলেন।